রাস্তা, টিউবওয়েল, টয়লেট উঁচুকরণ
এবং সুপেয় পানি দেখাবে বাঁচার পন্থা

এইচ এম আলাউদ্দিন ও মো: সদর উদ্দিন ঃ আইলা অতিবাহিত হয়েছে আজ থেকে ১৪ বছর আগে। কিন্তু অনেক কষ্টের স্মৃতি আজও রয়েছে হৃদয়ে। যা মনে উঠলে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। এমনই কয়েকটি স্মৃতির কথা তুলে ধরে কয়রার মানুষেরা বললেন অনেক কথা।
কয়রা সদর ইউনিয়নের নলপাড়া এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আইলার সময় পানি এতোটাই হয় যে, টয়লেটগুলো সব ডুবে গিয়েছিল। উপায় না পেয়ে ঘরের মধ্যে বসে টয়লেট করে মিষ্টির খালি প্যাকেটে করে পানিতে ভাসিয়ে দিতে হয়েছে। উত্তর বেদকাশির শ্যামসুন্দর মুন্ডা বললেন, আইলার সময় টয়লেটের জন্য ভাটির অপেক্ষা করতে করতে জোয়ার-ভাটার সাথে টয়লেটের একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। একদিন সহ্য করতে না পেরে তিনি দূরের একটি বাইন গাছে উঠে টয়লেট সেরে পানি ডিঙ্গিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পেলেন তার আগেই জোয়ারের পানিতে মলগুলো ভেসে আসছিল।
এছাড়া রাস্তা না থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে না পারা, টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় নৌকায় করে দূরের উঁচু কোন টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে বাধ্য হওয়ার মতো করুণ কাহিনীর কথাও তুলে ধরলেন কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণ বেদকাশির বাসিন্দারা। আর দুর্যোগকালীন এমন দুর্ভোগের চিত্র পর্যালোচনা করেই কয়রা উপজেলার দক্ষিণের ওই তিনটি ইউনিয়নে একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা, ১২৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ২৭টি উঁচু টয়লেট নির্মাণ এবং ১৪টি সাইক্লোন শেল্টারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ট্যাংক ও বেসিন স্থাপন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে স্থানীয় একজন ইউপি সদস্য বললেন, ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে যেটি ২০ বছরেও করা সম্ভব নয়, সেটি ওই বেসরকারি সংস্থা মাত্র দু’বছরে সম্পন্ন করে দেখিয়েছে। এভাবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসলে দুর্যোগপ্রবণ তথা উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা যে কোন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবেন বলেও আশা তাদের।
সরোজমিনে পরিদর্শনকালে কয়রা সদর ইউনিয়নের নলপাড়ার বাসিন্দারা জানালেন, বেসরকারি সংস্থা জাগ্রত যুব সংঘ বা জেজেএস’র পক্ষ থেকে যেভাবে উঁচু করে টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে তাতে আইলা, আম্ফানের ন্যায় যে কোন দুর্যোগ হলে অন্তত: সেখানকার বাসিন্দাদের টয়লেটের জন্য কষ্ট করে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। তাছাড়া পাশেই পানির জন্য রাখা হয়েছে টিউবওয়েলের ব্যবস্থা। এর ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সময় আসা পানি দিয়ে টয়লেটে ব্যবহার করারও প্রয়োজন হবে না।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বাবার বাড়ি হলেও এখন কয়রা সদরে বাস করেন গৃহবধূ শায়ন্তি। এখানে এসে তিনি আম্ফান, বুলবুল, সিত্রাংসহ কয়েকটি ঝড় দেখেছেন। এসময় ঘর পর্যন্ত পানি উঠে যাওয়ায় বাঁশের সাঁকো দিয়ে টয়লেটে যেতে হয়েছে। দূরের যেসব টিউবওয়েল উঁচু করে করা সেখান থেকে নৌকাযোগে গিয়ে খাবার পানি আনতে হতো। রাস্তা না থাকায় ঝড়ের আগে আশ্রয়কেন্দ্রেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন রাস্তা, টিউবওয়েল ও টয়লেট উঁচুকরণ করায় দুর্যোগের সময় তাদেরকে আর সে ধরনের দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হবে না।
‘আইলার সময় কি যে করুণ অবস্থা ছিল সেটি মনে উঠলে চোখে জল আসে’ এমনটি উল্লেখ করে দক্ষিণ বেদকাশির হেমলা নামের এক নারী জানালেন, বর্তমানে তিনি কয়রা সদরে থাকলেও বিয়ের আগে ছিলেন দক্ষিণ বেদকাশির বাবার বাড়ি। সেখানে আইলার সময় যখন আশ্রয়কেন্দ্রে যান তখন খাবার, পানিসহ নিদারুণ দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হতো। বিশেষ করে তারা তখন যে আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন সেখানে টয়লেট ছিলনা। টয়লেটের জন্য পানি ডিঙ্গিয়ে যেতে হতো পাশের নির্দিষ্ট স্থানে। অনেক সময় রাতের অপেক্ষা করতে হতো টয়লেটের জন্য।
কয়রা সদরের নলপাড়ার বাসিন্দা কবিতা জানান, পাশের একটি অফিসে গিয়েও তাকে টয়লেট করতে হয়েছে। কিন্তু এমন সুযোগ যাদের ছিল না তাদেরকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। রাতে সুবিধাজনক কোন এক খোলা মাঠে প্রাকৃতিক কাজটি সারতে হতো। যেটি অনেকের জন্য ছিল বিরাট ঝুঁকি। সম্প্রতি সেখানে রাস্তা করায় যেমন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া সহজ হবে তেমনি টয়লেট উঁচু করায় যে কোন দুর্যোগে দুর্ভোগ কমবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
৩ নং কয়রার বাসিন্দা ৭০ বছর বয়স্কা ফরিদা বেগম বলেন, তার বাড়ির পাশের রাস্তাটি উঁচু করায় দুর্যোগের সময় অন্তত: রাস্তার ওপরও থাকা যাবে। এজন্যই তারা রাস্তার জন্য নিজেদের জমির মাটি দিয়েছেন।
একই এলাকার আঞ্জুয়ারা খাতুন বলেন, তাদের বাড়ির পাশের রাস্তাটি আাগে অনেক নিচু ছিল। এতে ঝড়ের সময় নদীর পানি আসতো। বাড়িতে পানি উঠে যাওয়ায় তাদের গবাদি পশুও অন্য বাড়িতে গিয়ে রেখে আসতে হতো। কিন্তু এখন রাস্তা করার ফলে বাইরের পানি আসতে পারবে না। আবার পানি উঠলেও রাস্তা যেহেতু উঁচু হয়েছে সেখানেও গবাদি পশুগুলো রাখা যাবে।
রাস্তায় কাজ করেন এমন একজনের নাম শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, তারা এলাকায় বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজ করে সংসার চালান। জেজেএস’র রাস্তার কাজ পাওয়ায় তিনিসহ অনেকেই নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। এতে এক বেলা কাজ করে অন্তত: ৫শ’ টাকার মতো পান এক এক জনে। উত্তর বেদকাশি এলাকায় যারা রাস্তার কাজ করেন তারা বলেন, তারা যখন যে কাজ পান তাই করেন। রাস্তার কাজের সুযোগ পেয়ে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। পাশাপাশি এই রাস্তাই তাদের কাজে লাগবে সব সময়।
উঁচু টিউবওয়েল স্থাপনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে জেজেএস যে মানবিক কাজ করেছে সেটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন, উত্তর বেদকাশি মদিনাবাদ দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, এর আগেও জেজেএস ওই মাদ্রাসায় টয়লেট স্থাপন করে দেয়। বর্তমানে নলকূপের পাটাতন সংস্কার(উঁচুকরণ) প্রকল্পের মাধ্যমে যে টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে সেখান থেকে স্থানীয় বাসিন্দারাও সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পারছেন।
আইলার সময় রাস্তায় ছিলেন উত্তর বেদকাশির শীবপদসহ তার পরিবারের সদস্যরা। এরপর তারা প্রায় সাড়ে তিন বছর প্লাবিত ছিলেন। তখন টয়লেটগুলো তলিয়ে যায়। খোলা জায়গায় টয়লেট করতে বাধ্য হন। এজন্য রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কখনও কখনও নৌকায় করে দূরে গিয়ে টয়লেট করতে হয়েছে। এখন টয়লেট উঁচু করায় যে কোন দুর্যোগে তাদের সে সমস্যায় পড়তে হবেনা।
জনপ্রতিনিধিরা যা বললেন ঃ জেজেএস’র রাস্তা নির্মাণ, টয়লেট উঁচুকরণ, সুপেয় পানির জন্য টিউবওয়েল স্থাপন এমনকি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ সম্পর্কে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আছের আলী মোড়ল বলেন, রাস্তা, টিউবওয়েল ও টয়লেটের যে মান তা’ খুবই সন্তোষজনক। এতো টেকসই রাস্তা তাদের পক্ষে করা সম্ভব হতো কি না তা নিয়েও শংসয় প্রকাশ করেন তিনি। তবে রাস্তাটিকে আরও টেকসই করতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ইট সলিং করার প্রস্তাব করেন তিনি। কেননা ইউনিয়ন পরিষদের যে বাজেট তা’ দিয়ে রাস্তায় ইট সলিং দেয়া সম্ভব নয়।
উত্তর বেদকাশির ইউপি সদস্য আবু হাসান বলেন, একবার রাস্তা করার পর আবার তা’ সংস্কার করা হয় সেটি জেজেএস প্রমাণ করেছে। তাদের পক্ষে যেটি ২০ বছরেও সম্ভব হতো না সেটি মাত্র দু’বছরে করে দেখিয়েছে জেজেএস। আবার রাস্তার স্থায়িত্বের জন্য দু’পাশে গাছও লাগানো হয়েছে। এখন এর ওপর ইটের সলিং দেয়া হলে রাস্তাগুলো আরও টেকসই হবে। যেটি ইউনিয়ন পরিষদের ফান্ড থেকে করা যায় কি না সে চেষ্টা করা হবে বলেও তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। যদিও ইউনিয়ন পরিষদের সীমিত বাজেটে সেটি কতটা সম্ভব হবে তা’ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
কয়রা সদর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেন বলেন, জেজেএস যেসব রাস্তা করেছে তার সবগুলোতে বনায়ন করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই তাদের প্রকল্প মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। এজন্য যেসব রাস্তায় বৃক্ষরোপন করা সম্ভব হয়নি সেগুলোতে আগামী বৃষ্টি মৌসুমে সামাজিক বন বিভাগ থেকে বৃক্ষরোপন করা যায় কি না সেটি তিনি দেখবেন। তবে তিনি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে আরও কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করার আহবান জানান জেজেএস’র প্রতি।
বাস্তবায়নকারী সংস্থার বক্তব্য ঃ কয়রা রিহেবিলেশন প্রকল্প সম্পর্কে জেজেএস’র নির্বাহী পরিচালক এটিএম জাকির হোসেন বলেন, তারা দীর্ঘদিন উপকূলীয় এলাকায় কাজ করার সুবাদে দেখেছেন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নারী ও শিশুদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়। বিশেষ করে টয়লেট ব্যবস্থা নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে ওই এলাকার মানুষের। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে টয়লেট করেন আবার এজন্য রাতের অপেক্ষা করতে হয়। আবার কেউ নৌকায় ভাসমান অবস্থায়ও টয়লেট করতে বাধ্য হন। রাস্তা না থাকায় দুর্যোগের সময় অনেকে ইচ্ছা থাকলেও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেন না। এসব কারণে তারা সেখানে কেআরপি প্রকল্পের মাধ্যমে রাস্তা, টয়লেট ও টিউবওয়েল উঁচু করেন।
প্রকল্প সমন্বয়কারী আব্দুল মালেক বলেন, কেআরপি প্রকল্পের আওতায় কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। এজন্য ব্যয় হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮২ টাকা। এছাড়া তিন ইউনিয়নে ১২৫টি টিউবওয়েল, ২৭টি উঁচু টয়লেট ও ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাংকি ও বেসিন স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নয় দশমিক নয় আট আট কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ছয় দশমিক তিন নয় আট কিলোমিটার রাস্তায় চার হাজার ৫১টি নিম, মেহগনী ও সিরিস গাছ লাগানো হয়েছে।
সহকারী প্রকল্প সমন্বয়কারী নাজমুল হুদা বলেন, টিউবওয়েল ও টয়লেট নির্মাণের জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও রাস্তার কাজ জেজেএস’র নিজস্ব কর্মী দিয়েই সম্পন্ন করা হয়। এতে একদিকে যেমন কাজের মান ভালো হচ্ছে তেমনি স্থানীয় অনেক লোক কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে।
ফিল্ড সুপারভাইজার লাবনী আক্তার বলেন, স্থানীয় জনসাধারণ রাস্তার কাজে বেশ সহযোগিতা করছেন। বিশেষ করে নিজস্ব জমি থেকেও অনেকে রাস্তার জন্য মাটি দিয়েছেন। জনগনের সহযোগিতার ফলেই তারা টেকসই রাস্তাগুলো নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে দাতা সংস্থা শাপলা নীড়ের সহযোগিতায় জেজেএস ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ কাজগুলো সম্পন্ন করে। চলতি বছরের(২০২৩) ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।