হিসাবে গড়মিল
হওয়ার আশংকা
এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ সরকারি অনুমোদন না থাকলেও নগরীর কোন কোন প্রাইভেট ক্লিনিকে করোনার রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ওইসব প্রতিষ্ঠানে কোন রোগীর মৃত্যু হলে সরকারি হিসাবে সেটি অন্তর্ভুক্ত হয় না। আবার কতোটা পরীক্ষা হলো সে হিসাবও যুক্ত হয়না সরকারি খাতায়। যেটি নিয়ে অনেকটা বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে এমন আশংকা সংশ্লিষ্টদের। সম্প্রতি দু’জন রোগীকে দু’টি বেসরকারি ও একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে নগরীর ময়লাপোতা মোড়ের সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আব্দুর রশীদ(৭২) নামের এক রোগী। র‌্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষা করে করোনা শনাক্ত হয় গত ১১ জুলাই। এরপরই তাকে সেখান থেকে করোনার চিকিৎসা হয় এমন হাসপাতালে নিতে বলায় রোগীর স্বজনরা তাকে নিয়ে যান খুলনা জেনারেল হাসপাতালে। তারও দু’দিন আগে একই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন আব্দুর রশীদের স্ত্রী নাসিমা রশিদ(৬৪)। স্বামী-স্ত্রী দু’জনকে একইসাথে নেয়া হয় খুলনা জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে নাসিমা রশিদের করোনা পরীক্ষার পর পজিটিভ হয়। কিন্তু সেখানের পরিবেশ পছন্দ না হওয়ায় তাদেরকে অন্য কোন স্থানে নেয়ার চেষ্টা করেন রোগীর স্বজনরা। এক পর্যায়ে রোগীর স্বজনরা নগরীর কেডিএ এভিনিউস্থ রাশিদা মেমোরিয়াল হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন সেখানে করোনা রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়। জেনারেল হাসপাতালে একদিন থাকার পর নিজেরাই তাদেরকে নিয়ে আসেন রাশিদা মেমোরিয়ালে। সেখানে চিকিৎসা নেন তিনদিন। ৫১০ নম্বর কেবিনের দু’বেডে দু’জন অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীকে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। তিনদিন পর দু’জনের রিএকটিভ প্রোটিন(সিআরপি) পরীক্ষা হয় রাশিদা মেমোরিয়ালে। আব্দুর রশীদের ফলাফল নেগেটিভ হলেও স্ত্রী নাসিমা রশীদের হয় পজিটিভ। তবে হাসপাতাল থেকে তাদের দু’জনকেই বাসায় নিতে বলা হয়। আর তিনদিনে শুধুমাত্র অক্সিজেন ও কেবিন ভাড়ার বিল করা হয় ৫৮ হাজার টাকা।
এদিকে, খুলনার সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, খুলনায় একমাত্র গাজী মেডিকেল ছাড়া অন্য কোন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে করোনার রোগীদের চিকিৎসার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়নি। সুতরাং কেউ যদি স্ব উদ্যোগে করোনার রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন তার দায়ভার তাকেই বহন করতে হবে।
অনুমোদন ছাড়া করোনার রোগীদের চিকিৎসা বা পরীক্ষা হলে সেটি সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মাধ্যমে সরকারি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়না। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আছে তাদের সাথে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একটি যোগসূত্র থাকে। সুতরাং অনুমোদনবিহীন কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিক করোনার মতো একটি স্পর্শকাতর রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারে না। তবে কেউ যদি গোপনে এমনটি করে থাকেন তাহলে তাদের পক্ষে জানাও সম্ভব নয়। এজন্য তিনি সাধারণ মানুষকে তাদেরকে সহযোগিতা দেয়ার আহবান জানান।
অপরদিকে, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা: সেলিম বলেন, করোনার রোগীদের জন্যতো আলাদা কোন চিকিৎসা নেই, সবইতো একই চিকিৎসা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার যদি চিকিৎসা দেন তাহলে ক্ষতি কি ?
প্রথমে অবশ্য তিনি বলেছিলেন, করোনা রোগীদের তার ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়না। তবে আব্দুর রশীদ দম্পতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনিতে জ¦রের রোগীদের আলাদা ইউনিট করে চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে ওই দু’রোগীর করোনার পরীক্ষায় ফলাফল পজিটিভ হওয়ার পরও কিভাবে তাদেরকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিকিৎসায়তো কোন পার্থক্য নেই। তাছাড়া এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার আছে। প্রথমে করোনার উপসর্গ নিয়ে রোগী আসে। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায় পজিটিভ। সেই রোগী অন্য কোথাও পাঠালেতো মারা যেতে পারে। এজন্যই সেখানে রেখেই চিকিৎসা দেয়া হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাশিদা মেমোরিয়ালের করোনা ইউনিটের ইনচার্জ বাবু নামের একজন। তার নম্বর দেন তিনি নিজেই। তার সাথে কথা বলেও জানা যায় সেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আলাদা ইউনিট করে সেখানে জ¦র-শ^াসকষ্টের রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে ওই রোগীদের করোনার বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয় ওই ক্লিনিকেই। এরপর ফলাফল পজিটিভ হলে সেখানে রেখেই চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে রোগীর অবস্থা খারাপ হলে রাখা হয়না বলেও তিনি জানান।
করোনার রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়ার সুব্যবস্থা এখানে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অক্সিজেনের যাতে ঘাটতি যাতে না থাকে সেজন্য ঢাকা থেকে বড় বড় চারটি সিলিন্ডার এনে রাখা হয়েছে। ‘আমরা এখানে সেবা দিতে বসেছি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ১৮ থেকে ২০টি রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। পজিটিভ রোগীও তাদের চিকিৎসায় নেগেটিভ হয়েছেন।
হাসপাতালের তিন তলায় আলাদা করোনার ইউনিট করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য আলাদা জনবল রয়েছে। রয়েছে নার্স, স্টাফসহ অন্যান্য কারিগরি জনবলও। সুতরাং কোন সমস্যা নেই।
খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিদিন খুলনার যেসব হাসপাতালে করোনার রোগীদের চিকিৎসা ও পরীক্ষা হয় সেগুলোর তথ্য তারা সংগ্রহ করেন। সেগুলো পরেরদিনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। প্রথমে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তরে এবং পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে আইইডিসিআর-এ পাঠানো হয়। যেগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচার করা হয়। কিন্তু যেসব প্রাইভেট হাসপাতালের অনুমোদন নেই তাদের তথ্য তারা সংগ্রহ করেন না। সুতরাং ওইসব ক্লিনিক বা হাসপাতালে কয়জন রোগীর মৃত্যু হলো, কয়জনের চিকিৎসা হলো অথবা কয়টি নমুনা পরীক্ষা হলো এর কোন হিসাবই তাদের রাখার সুযোগ থাকে না।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী খুলনায় চারটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এর মধ্যে তিনটি সরকারি ও একটি বেসরকারি। সরকারি হাসপাতালগুলো হচ্ছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা জেনারেল হাসপাতাল ও শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একমাত্র গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার ইউনিট রয়েছে। হিসাব অনুযায়ী খুমেক করোনা ইউনিটে দেড়শ’ বেড, জেনারেল হাসপাতালে ৮০টি বেড, আবু নাসের হাসপাতালে ৪৫টি বেড এবং গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেড়শ’ বেড রয়েছে।
ডেব অনুযায়ী প্রতিদিনই রোগীর সংখা বেশি থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে করোনার ইউনিট খুলতে বলা হলেও একমাত্র গাজী মেডিকেল ছাড়া অন্য কেউ সাড়া দেয়নি। কিন্তু এভাবে গোপনে চিকিৎাস দেয়া হলে হিসাবে গড়মিল হতে পারে বলেও সিভিল সার্জন উল্লেখ করেছেন।