* মধুমতি নদীর পরিশোধিত পানিতেও মাত্রাতিরিক্ত লবণ
* শুষ্ক মৌসুমে কাজে আসছে না ২৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প

প্রকল্পের নামে যা’ হলো

এ এইচ হিমালয় ঃ গত প্রায় দুই দশক ধরে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল খুলনার মানুষ। নলকূপ দিয়ে চাহিদার শতভাগ পানিই ভূ-গর্ভ থেকে উত্তোলন করা হতো। শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে গেলে দেখা দিতো পানির কষ্ট। হস্তচালিত নলকূপ থেকে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যেতো। ওয়াসার উৎপাদক নলকূপের পানিও কমে যেতো। পানির জন্য নগরজুড়ে শুরু হতো হাহাকার।
মানুষের পানির কষ্ট নিরসন এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে মধুমতি নদীর পানি পরিশোধন করে সরবরাহের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ওয়াসা। গত দেড় বছর ধরে গ্রাহকদের সেই পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে ফের পানির কষ্টে ভুগছে খুলনার মানুষ। ওয়াসার পাইপলাইনে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। যেটুকু পানি পাওয়া যাচ্ছে তাতেও লবণের আধিক্য বেশি। যার কারণে মানুষকে ফের উৎপাদক নলকূপের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। নলকূপে পানি কমে যাওয়ায় ফের পানির কষ্ট শুরু হয়েছে নগরজুড়ে। আড়াই হাজার কোটি খরচের পরও সেই পুরাতন কষ্ট মানতে পারছে না খুলনার মানুষ।
প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও পানি সংকটের কারণ, ওয়াসার প্রকল্পের কার্যক্রম এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে গত দুই মাস ধরে অনুসন্ধান করেছে দৈনিক পূবাঞ্চল।
দেখা গেছে, পরিশোধন কেন্দ্রে পানি শুধু বিশুদ্ধ হয়, লবণাক্ততা যায় না। যার কারণে নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় পরিশোধিত পানিতেও অতিরিক্ত লবণ থেকে যাচ্ছে। এই পানি ব্যবহার করা যায় না।
লবণাক্ততার কারণে পরিশোধন কেন্দ্রের পানি যে ব্যবহার করা যাবে না-এ বিষয়ে আগাম কোনো ধারণাই ছিলো না ওয়াসা কর্মকর্তাদের। প্রকল্পের কোনো পর্যায়েই এই বিষয়টি নিয়ে কখনো আলোচনা হয়নি। যার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে ওয়াসা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিশোধিত পানি সরবরাহ কমিয়ে লবণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সংস্থাটি। বিকল্প হিসেবে উৎপাদক নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভ থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। অথচ উৎপাদকগুলো নলকূপ বন্ধ রেখে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতেই বিশাল ব্যয়ের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সংকটের সময় মেগা প্রকল্পটি কাজে লাগছে না।
॥ সমস্যার শুরু ॥
‘খুলনা পানি সরবরাহ’ নামের এই মেগা প্রকল্পটি ১০ বছর আগে শুরু করে বছর দেড়েক আগে চালু করে খুলনা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষÑখুলনা ওয়াসা। নগরীর ১০টি বিভিন্ন এলাকায় পানি পৌঁছায় গত বছর ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু এপ্রিলেই ধরা পড়ে লবণ। হই চই পড়ে গেলে পানিতে লবণের উৎস খুঁজতে নামে ওয়াসা। কিন্তু খুঁজে পায় না কিছুই। প্রথম দিকে গভীর নলকূপের পানিতে নোনা বেশি পাওয়ায় ৫৮টির মধ্যে ৫টিই বন্ধ করে দেয় ওয়াসা। তাতেও কাজ না হওয়ায় ওই মাসেই মোল্লাহাটে মধুমতি নদীর পানি উত্তোলন কেন্দ্র, রূপসার সামন্তসেনায় পানি পরিশোধন কেন্দ্র, নগরীর ভেতরে ওয়াসার ৭টি রিজার্ভার এবং বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা পানি পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, মধুমতি থেকে এনে পরিশোধন করা পানিতেই লবণ রয়েছে। পরে পানি পরিশোধন কমিয়ে গভীর নলকূপ চালু করে নগরবাসীকে পানি দেওয়া হয় কমিয়ে কমিয়ে। কিন্তু পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখে ওয়াসা। পরের মাসেই বৃষ্টির কল্যাণে নোনা কমে আসে নদীতে, আর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ওয়াসা। কিন্তু চলতি বছর এপ্রিলে শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে আবার ঘটে সেই বিপত্তি। নগরীর বিভিন্ন এলাকার সাপ্লাইয়ের পানিতে দেখা দেয় লবণ। সেই পানি ব্যবহার করতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন নগরবাসী। এবারও জোড়াতালি দিয়ে, সাত-পাঁচ করে ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টা শুরু করেছে ওয়াসা।
তবে দুই মাসের টানা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঋণের বিপুল অর্থ ব্যয়ের একটা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেউ দূরদর্শিতার পরিচয় দেননি। প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার সময় ১০/১৫ বছর পরে ভবিষ্যতে নদীর পানি প্রবাহ কেমন থাকবে, তা‘ যাচাই করা হয়নি। পরিবেশবিদদের কোনো আপত্তি কানে তোলা হয়নি। দূরদৃষ্টি দিয়ে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করা হয়নি।
॥ পরিশোধনে লবণ যাচ্ছে না ॥
নগরীতে পানি সরবরাহ করা হয় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রূপসা উপজেলার সামন্তসেনা গ্রামে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে। আর ট্রিটমেন্ট প্লান্টে পানি আসে ৩৪ কিলোমিটার দূরের মধুমতি নদীর মোল্লাহাট সেতু এলাকা থেকে।
সম্প্রতি পানি পরিশোধন কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা গেছে, মধুমতি নদীর অপরিশোধিত পানি প্রথমে রিজার্ভারে রাখা হয়। সেখান থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি নেওয়া হয় পরিশোধন কেন্দ্রে। বিশাল কেন্দ্রে কয়েকটি ধাপে পানি পরিশোধন করা হয়। এসব ধাপে নদীর পানির ঘোলাত্বভাব দূর করে স্বচ্ছতা নিয়ে আসে, সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং জীবণু ধ্বংস করা হয়, পানিকে ভাসমান কণা (খালি চোখে দেখা যায় না) মুক্ত করা হয় এবং পানির দুর্গন্ধ দূর করা হয়। পরিশোধন প্রক্রিয়ায় লিক্যুইড পলি অ্যালোমোনিয়াম ক্লোরাইড ও লিক্যুইড ক্লোরিনের ব্যবহার হয় বেশি। পরিশোধনের কোনো পর্যায়ের লবণাক্ততা শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে পরিশোধনের পরও পানিতে লবণ থেকে যাচ্ছে।
কেন সেই ব্যবস্থা রাখা হয়নি জানতে চাইলে পানি পরিশোধন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী আরমান সিদ্দিকী পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। যে কোনো বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে তাঁর কাছ জানা যায়, লবণাক্ততার মাত্রা ৫০ থেকে ৬০০ পিপিএমের (মিলিগ্রাম পার লিটার) ভেতরে থাকলে সেই পানি ব্যবহারযোগ্য হিসেবে ধরা হয়।
তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে পাওয়া ওয়াসার তথ্যই বলছে, গত ১ মে মধুমতি নদীর পানিতে লবণাক্ততা ছিল ১১৩০ পিপিএম; পরিশোধনকেন্দ্র থেকে রিজার্ভারে এসে সেটা দাঁড়ায় ১০৪০ পিপিএম। এর কারণ জানা যায়, কেন্দ্রে নোনা পরিশোধের ব্যবস্থা না থাকলেও অনেক সময় রিজার্ভারে জমা থাকা শুষ্ক মৌসুমের আগের পানির সঙ্গে মিশে গড়ে লবণাক্ততার মাত্রা কমে যায়। এভাবে গোঁজামিলের পরিশোধিত পানিতে গত ২মে ১১১০ পিপিএম, ৩ মে ১১৯০, ৪ মে ১৩৮০, ৫মে ১৪৬০ এবং সবশেষ ১৬ মে ১৮১০ পিপিএম নোনা পানি পাওয়া গেছে বলে জানায় খুলনা ওয়াসা।
এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল্লাহর শরণাপন্ন হলে তিনি বলেন, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পানির সব ধরনের ক্ষতিকর উপাদান ব্যাকটেরিয়া, ভাসমান কণা, ময়লা-ঘোলা, দুর্গন্ধ সবই পরিশোধন করে পানযোগ্য করা হয়।
‘কিন্তু ওই পানি তো কেউ পান করতে পারছে না মাত্রাতিরিক্ত নোনার কারণে। নোনা পরিশোধনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি কেন’ জানতে চাইলে এমডি বলেন, ‘নদীর পানির লবণাক্ততা দূর করে ব্যবহার করা এতোটাই ব্যয়বহুল যে, এমন কিছু করার কথা কারও ভাবনায়ও আসেনি।’ তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর পানিতে লবণাক্ততা এভাবে বাড়বে, সেটা ওই সময় বোঝা যায়নি। এছাড়া মধুমতির উজানের নদী গড়াই খননের বিষয়ে আলোচনা চলছিল। সেটা হলে মধুমতির পানিপ্রবাহ ও লবণাক্ততা স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
তবে ওয়াসা এমডির যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে দেশের প্রখ্যাত পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত গত ১৭ মে পূর্বাঞ্চলকে বলেন, ‘মধুমতি নদীতে লবণাক্ততা বাড়বে, এটা গত ২০ বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। দেশের প্রায় সব পানি বিশেষজ্ঞ এটা জানেন। এতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে এসে কেউ যদি বলে, এতোটা লবণ বাড়বে আমরা জানতাম নাÑ এটা আমি মানতে রাজি না।’ জানতে চাইলে খুলনার এই কৃতীসন্তান বললেন, ‘না, এই প্রকল্প নিয়ে খুলনা ওয়াসা আমাকে কখনো ডাকেনি, কোনো আলোচনাও করেনি।’
দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে খুলনা অঞ্চলের পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত। এই মেগা প্রকল্পের পরিকল্পনা চলাকালে বিভিন্ন পরিবেশবাদি সংগঠনের সভা-সেমিনারে তিনি নিয়মিত অংশ নিতেন। গত ১৯ মে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে ওয়াসার কোনো যোগযোগ হয়নি। ওই সময় সভা-সেমিনারগুলোতে আমি তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে বলেছি, বছরের ৪-৫ মাস মধুমতি নদীর পানি ব্যবহার করা যাবে না। ভবিষ্যতে এই সংকট আরও বাড়বে। লবণ এবং উৎপাদন খরচ এতো বেশি হবে যে, এক সময় প্রকল্পটি আর কাজে আসবে না।’
॥ ওয়াসা ছাড়া সবাই জানতো নদীতে লবণ বাড়বে ॥
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, খুলনা অঞ্চলের মানুষ সাধারণত ২ ডিএস মিটার (ডেসি সিমেন পার মিটার) লবণাক্ততা পর্যন্ত পানি খাওয়া ও রান্নার কাজে ব্যবহার করেন। কিন্তু গত ১৫-১৬ বছর ধরেই শুষ্ক মৌসুমে মধুমতি নদীর পানির লবণাক্ততা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি রয়েছে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে গত ১৬ বছরের লবণাক্ততার তথ্য যাচাই করেছে পূর্বাঞ্চল। সংস্থাটি লবণাক্ততা পরিমাপ করে ডিএস মিটার এককে। দেখা গেছে, মধুমতি নদীর যে জায়গা থেকে ওয়াসা পানি তোলে, সেখানে ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে লবণাক্ততা ছিল ১ দশমিক ৪ ডিএস মিটার, ২০০৬ সালের এপ্রিলে ১ দশমিক ৯ এবং মে মাসে ২ দশমিক ৯ ডিএস মিটার। আর মেগা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপ চলাকালে ২০০৯ সালের মে মাসে মধুমতির লবণাক্ততা ছিল ৪ দশমিক ৮ ডিএস মিটার। ২০১০, ২০১১, ২০১২ সালের এপ্রিল মাসেও ৪-৫ ডিএস মিটারের মধ্যেই ছিল লবণাক্ততা। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল মধুমতি নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা পাওয়া যায় ৭ দশমিক ২ এবং ৩০ এপ্রিল ৮ দশমিক ৩ ডিএস মিটার।
বিস্ময়কর ও রহস্যময় বিষয় হলো, এত ব্যয়বহুল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে মৃত্তিকা সম্পদের কাছ থেকে এই অতি প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের প্রয়োজনই মনে করেনি খুলনা ওয়াসা। এমনকি, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপকারী সংস্থা জাপানের এনজেএস কনসালট্যান্ট সেসময় মধুমতির পানির লবণাক্ততা বিষয়ে প্রায় একই রকম তথ্য পেয়েছিল, কিন্তু ওয়াসা সেটাও আমলে নেয়নি আবার এনজেএসও কোনো পরামর্শ দেয়নি ওয়াসাকে।
২০১০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩-র ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন বিধান কুমার ভান্ডার। বর্তমানে তিনি ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে প্রধান কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ১৬ মে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘ওয়াসার এই প্রকল্পের কথা শুনেছি, কিন্তু ওয়াসার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কোনো তথ্য চাওয়া হয়নি। চাইলে হয়তো আমরা তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে পারতাম।’
তিনি আরো বলেন, হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে দূরদৃষ্টি থাকতে হবে অন্তত ৫০ বছরের। তখন নদীর পানির লবণাক্ততা, এর বৃদ্ধির হার এবং ১০-১৫ বছর পর কী হবেÑএসব ভালোভাবে গবেষণা করা উচিত ছিল।
লবণ আনা হয়নি কেন?
জাপান ইন্টারন্যাশাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) উদ্যোগে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় ২০০৯-২০১০ সালে। এজন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয় জাপানের এনজেএস কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডকে। ২০১১ সালের মার্চে প্রতিবেদন জমা দেয় সংস্থাটি। প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০৯ ও ২০১০ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে ভৈরব নদের ফুলতলা, রূপসা নদীর রূপসা ঘাট এলাকা এবং মধুমতি নদীর মোল্লাহাট, বোলতলি, হরিদাশপুর ও চাপালি ঘাট এলাকার পানি পরীক্ষা করেছে সংস্থাটি। পরে জমি অধিগ্রহণ, ব্যয়সহ নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মধুমতি নদীর মোল্লাহাট পয়েন্ট থেকে পানি আনার প্রস্তাব দেয় তারা।
প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, মাত্র দুই বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করেই শুষ্ক মৌসুমের ১৫ দিন পানিতে লবণাক্ততা থাকবেÑ এমন ধারণা থেকেই প্রকল্পের নকশা তৈরি করা হয়েছে। ২০২৫ সালে খুলনার জনসংখ্যা এবং পানির চাহিদা কতো থাকবে, তা বলা হয়েছে। অথচ ২০২৫ সাল নাগাদ মধুমতির পানিপ্রবাহ কেমন থাকবে, লবণের পরিমাণ কেমন হতে পারে-তার কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি।
এনজেএস কনসালট্যান্ট কোম্পানির প্রধান কার্যালয় জাপানের টোকিওতে। এতো বড় প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমলে না নিয়ে কিভাবে প্রকল্প তৈরি করা হলো, তা’ জানতে সংস্থাটির সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ওই সময়ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন প্রকৌশলী আবদুল্লাহ। তিনিই মূলত সার্বিক বিষয় মনিটরিং করতেন। ‘নদীর পানিই প্রকল্পের মূল উপকরণ। কিন্তু তাতে লবণাক্ততার বিষয়টি কেন উপেক্ষিত হলো’Ñ জানতে চাইলে গত ১৭ মে তিনি বলেন, জাইকা সরাসরি এনজেএসকে নিয়োগ দিয়েছিল। তারাই পরিকল্পনা তৈরি করেছে। বিষয়টি আমলে নেওয়া উচিত ছিল তাদের।
‘সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য ও পরিবেশবাদীদের আপত্তি ওই সময় কেন আমলে নেওয়া হয়নি প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সম্ভাব্যতা জরিপ করে এনজেএস জানিয়েছিল, এপ্রিল মাসে ১০-১৫ দিন পানিতে কিছুটা লবণ থাকবে। ওই ১৫ দিনের জন্য তারা একটি রিজার্ভার তৈরি এবং আগে থেকে পানি মজুদ রাখার পরামর্শ দেয়। ওই সময় পুরো প্রস্তাব নিয়ে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং-আইডব্লিউএমের পানি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করা হয়। দেশের শীর্ষ পানি বিশেষজ্ঞরা এভাবে কাজ করার পক্ষে মত দেন।
ওয়াসার প্রকল্প চলাকালে আইডব্লিউএমের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন প্রকৌশলী ইমাদউদ্দিন আহমেদ। করোনা আক্রান্তের পর তিনি এখন বিশ্রামে রয়েছেন। তাই যোগাযোগ করেও তাঁর কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির ওয়াটার রিসোর্স প্লানিং শাখার বর্তমান পরিচালক সোহেল মাসুদ গত ১৬ মে পূর্বাঞ্চলকে বলেন, ওই সময় যেসব সিনিয়র স্যাররা ছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগই অবসরে চলে গেছেন। তখন আমাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না; বর্তমান দায়িত্বরতরাও কিছু বলতে পারছেন না। এ সংক্রান্ত কোনো নথিও আমাদের কাছে নেই।