/ নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে অচলাবস্থা: দখল-পাল্টা দখলে চরমে উত্তেজনা, প্রশাসন ও শিক্ষা কার্যক্রম বিপর্যস্ত

নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে অচলাবস্থা: দখল-পাল্টা দখলে চরমে উত্তেজনা, প্রশাসন ও শিক্ষা কার্যক্রম বিপর্যস্ত

খুলনার প্রথম বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে চলছে চরম অচলাবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দখল-পাল্টা দখলের লড়াইয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক ও শিক্ষার পরিবেশ। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো একে অপরকে অবৈধ নিয়োগ, জাল স্বাক্ষর, ভয়ভীতি এবং রাজনৈতিক মদদে দখলদারির অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ অনুমোদিত চেয়ারম্যান না হয়েও মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি নিজেকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। তার নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থীর মাধ্যমে ১৯ জুন উপাচার্য অধ্যাপক শেখ মো. এনায়েতুল বাবরকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এর আগে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সাহিদা খানমকে রাত ১১টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগে ২৫ জুন সোনাডাঙ্গা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
জিডিতে সাহিদা খানম অভিযোগ করেন, মিজানুর ও হাফিজুর রহমান নিজেদের চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব দাবি করে ভর্তি ও অন্যান্য কার্যক্রমে অর্থ তছরুপ করছেন।

ট্রাস্টি বোর্ডের পূর্ববর্তী চেয়ারম্যান ও বিএনপি-সমর্থিত সিরাজুল হক চৌধুরী দাবি করছেন, মিজানুর রহমান বোর্ডের বৈধ সদস্য নন। তিনি অভিযোগ করেন, ২১ মে ডাকা সভায় তার জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করে মিজানুর নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন, যেখানে অধিকাংশ বৈধ সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এবং ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করেছেন যেন ‘অবৈধভাবে টাকা তোলা না যায়’।

সিরাজুল হক বলেন, “এক কোটি টাকার অতিরিক্ত বিল নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই শুরু হয় এ বিরোধ। এরপর রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে তারা ক্যাম্পাস দখলে নিচ্ছে।”
অন্যদিকে মিজানুর রহমান দাবি করেছেন, “ট্রাস্টি বোর্ডের বেশিরভাগ সদস্য ফ্যাসিস্টদের দোসর। তাদেরই অনুরোধে আমি দায়িত্ব নিয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “আমরা ইউজিসির অনুমোদিত ট্রাস্টি। আলাদা নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই।”
তবে যৌথ মূলধনি কোম্পানিতে নিবন্ধন ছাড়াই নতুন তিন সদস্যকে বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সিরাজুল হক নিজেই স্বীকার করেছেন, আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রিত বোর্ডে ভারসাম্য আনতে তিনি বিএনপি-ঘনিষ্ঠ সদস্য নিয়েছিলেন, কিন্তু নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, মিজানুর রহমানের পক্ষে কাজ করতে ট্রাস্টি সদস্যদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ট্রাস্টি তৌহিদুল ইসলাম আজাদ, সৈয়দ মো. ওবায়দুল্লাহ ও পবিত্র কুমার সরকারকে বিএনপির এক সমাবেশে হামলার মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, যদিও মামলার বেশিরভাগ আসামি আওয়ামী লীগের।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমরা উভয় পক্ষকে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছি। যদি তা না হয়, তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

২০১২ সালে অনুমোদনপ্রাপ্ত নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি শুরু থেকেই রাজনৈতিক ছায়ায় পরিচালিত হয়ে এসেছে। শুরুর দিকে চেয়ারম্যান ছিলেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গেই পরিচালনার দায়িত্বও দখল হয়ে যাচ্ছে এক গোষ্ঠী থেকে আরেক গোষ্ঠীর হাতে। এর ফলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিগত ও প্রশাসনিক কাঠামো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা লেখাপড়া করতে এসেছি, কিন্তু প্রতিদিন অশান্তি, তালা, মিছিল, ভীতি নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। শিক্ষকরা অনিশ্চিত, রেজাল্ট আটকে আছে। ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”