বৈদেশিক মূদ্রা
আয়ের মাধ্যম

জিএম মিজানুর রহমান, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি ঃ নারকেলের যথাযথ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাগেরহাটের একটি কারখানা। কারখানায় নারকেলের প্রতিটি অংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে দুর্লভ দ্রব্য। দেশ-বিদেশে রয়েছে এসব দ্যব্যের ব্যাপক চাহিদা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ শিল্পকে একটি জাতীয় অর্থৈনৈতিক আয়ের বড় উৎস হিসেবে কাজে লাগাতে চান উদ্যোক্তা।
সূত্রটি জানায়, নারকেলের ছোবড়া এখন বৈদেশিক রপ্তানী পণ্যের কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নারকেলের ছোবড়া থেকে যন্ত্রের সাহায্যে গুঁড়া ও আঁশ আলাদা করে সেই আঁশ দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি করা হচ্ছে তোশকের (ম্যাট্রেস) ভেতরের অংশ। যা কয়ার ফেল্ট নামে পরিচিত। নারকেলের ছোবড়ার পাশাপাশি ছোবড়ার গুঁড়াকে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। শুরুতেই এগুলোর বাজার পাওয়া গেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। এনএস কয়ের নামের বাগেরহাটে ন্যাচারাল ফাইবার কারখানায় তৈরি হচ্ছে এসব পণ্য। বাগেরহাটের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্প নগরীতে এবং রাখালগাছি ইউনিয়নের করুরীতে এই কারখানাটি অবস্থিত।
উৎপাদন কারখানায় গিয়ে কথা হয় পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো: জোবায়ের হোসেনের সাথে। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সাল থেকে ‘কয়ার ফেল্ট’ (ম্যাট্রেস তৈরির কাঁচামাল) তৈরি করে আসছে। আর এ উৎপাদিত কাচামালগুলি সোয়ান, আখতার, অটোবিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ম্যাট্রেস উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে । আর নারকেলের আঁশ থেকে উৎপাদিত গুড়া রোদে শুকিয়ে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে চাপ দিয়ে ‘কয়ার পিট’, ব্লক এবং গ্রো ব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে। দেশের বাজারে কয়ার ফেল্টের চাহিদা মেটানোর পর এখন নতুন পণ্য কয়ার পিট র‌্যাপিং পেপারে মুড়ে রপ্তানি করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে গবাদি পশুপালন ফার্মে ও কৃষিকাজে মাটির বিকল্প হিসেবেও কয়ার পিটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গার্ডেনিং এর সয়েল কন্ডিশনার, জৈব সারসহ বিভিন্ন কাজের বিশে^র বিভিন্ন দেশে এর চাহিদা রয়েছে।
কারখানার স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজ আহমেদ জানান, তিনি ১৯৮৪ সালে আইএসসি পাস করে ব্যবসায় নেমে পড়েন। নারকেল তেল তৈরির কারখানায় উৎপাদিত ছোবড়া শুধুমাত্র জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হতো। লাভজনকভাবে এই ছোবড়াকে ব্যবহার করতে তিনি ভারতের হরিয়ানা, দিলি, কেরালা, তামিলনাড়ু ও ওডিশাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন কারখানায় ছোবড়া দিয়ে কয়ার ফেল্ট তৈরির কৌশল দেখে উদ্বুদ্ধ হন। পশ্চিমবঙ্গের কয়ার ফেল্ট তৈরির এক কারখানার সঙ্গে চুক্তি হয়ে বাগেরহাটের শ্রমিক নিয়ে প্রশিক্ষিত করে ২০০৫ সালে তিনি কারখানার উৎপাদন কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তার কারখানায় প্রায় শতাধিক শ্রমিক কাজ করছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউএসএআইডির এগ্রিকালচার ভ্যালু চেইন (এভিসি) প্রজেক্টের আওতায় জার্মানের ফ্রাঙ্কফুর্ট ফেয়ারে অংশ নিয়ে তিনি বিশ্ববাজারে কয়ার পিটের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা পান। ১৪-১৫টি দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের সাথে ই-মেইল আদান-প্রদানের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসের সহযোগিতায় গত অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ার ডায়াপিট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিন সুক কিম একজন ক্রেতা হিসেবে এ কারখানা পরিদর্শনে এসে এসব উৎপাদিত পণ্যের পছন্দ করে ক্রয়াদেশ দেন। তিনি আরও জানান, ‘আমাদের দেশে কয়ার পিটের চাহিদা প্রচুর। পণ্যটির পানি শোষণক্ষমতা ব্যাপক, তাই শূকর, ভেড়া, ঘোড়া ও গরু পালনের খামারের মেঝেতে ব্যবহৃত হয়, যাতে মলমূত্র শুষে নিতে পারে। পরে ব্যবহৃত কয়ার পিট জৈব সার হিসেবে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া ফসলের চারা উৎপাদনেও এটি ব্যবহার করা হয়।’ ভারতের কয়ার বোর্ডের হিসাব মতে সারা বিশ্বে নারকেলের আঁশের উৎপাদন বছরে সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন। এর ৯০ ভাগই জোগান দেয় ভারত ও শ্রীলঙ্কা। প্রচলিত পদ্ধতিতে গুঁড়া শুকাতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে কারখানাটি। তাই নিজেরাই কারখানায় ড্রায়ার যন্ত্র সংযোজিত করে আধুনিকায়ন করেছে কারখানাটি। নারকেলের ছোবড়া থেকে উৎপাদিত আঁশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার সম্ভাবনার কারণে বানিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গেজেটে ৩.৫.২ (১৪) ধারায় নারকেলের ছোবড়াকে বিশেষ উন্নয়নমূলক খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারী রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নীতি শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মো: সলিম উল্লাহ নারকেলের ছোবড়ার আঁশ নির্ভর শিল্পকে জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬ এর অগ্রাধিকার খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্তি করে প্রজ্ঞাপন জারী করেন। যা ২০১৮ সালের ৮ মার্চ গেজেটের ১০নং ধারায় প্রকাশিত হয়। কারখানার উৎপাদিত পণ্য তিনি বিদেশে রপ্তানী করছেন। কারখানার সফলতার কারণে নারকেলের ছোবড়ার আরও কিছু পণ্য তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান। নারকেল শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কারণে নারকেল চাষীরা নারকেলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে। ভারতের মতো এ শিল্পে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সার্বিক সহযোগিতা পেলে এই শিল্পের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
তিনি আরও জানান, মাত্র ৪/৫ বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এখন নারকেলের সকল অংশ দিয়ে তৈরি করছেন বিভিন্ন দ্রব্য। নারকেল দিয়ে তৈরি হচ্ছে ভারজিন কোকোনাট ওয়েল। উৎপাদিত কারখানার উচ্ছিষ্ট সাদা গুড়া নিয়ে তৈরি হচ্ছে ডেসিকেটেড পাউডার। যা বিভিন্ন কারখানায় কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নারকেলের পানি দিয়ে তৈরি হয় ন্যাচারাল ভিনেগার। আর এসব কর্মকান্ড যান্ত্রিক উপায়ে যথোপযুক্ত ব্যবহারের জন্য বিদেশ থেকে দক্ষ কারিগর আনা হয়েছে।
ইতোমধ্যে হল্যান্ড থেকে একজন স্পেশালিষ্ট এসেছেন আর ২/৪ দিনের মধ্যে সাউথ কোরিয়া থেকে আরেক জন বিশেষজ্ঞ আসবেন। কারখানার সফলতার কারণে নারকেল আরও কিছু পণ্য তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান। নারকেল শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কারণে নারকেল চাষীরা নারকেলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে। ভারতের মতো এ শিল্পে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সার্বিক সহযোগিতা পেলে এই শিল্পের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা অনেক। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ভারত দু’লাখ ৭৩ হাজার রূপীর মূল্যমানের পণ্য রপ্তানী করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানীর বিপরীতে নগদ সহায়তা (ইনসেন্টিভ) পায় ২৭%-৩০%। অথচ সেদিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে পিছিয়ে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ২০% নগত সহায়তা পেলেও চলতি বছরে তা কমে ১০%এ দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন ও রপ্তানী পর্যায়ে সহায়তা পেলে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।