এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে খুলনার পুরানো কোনো সংস্থা আগ্রহ দেখায়নি। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদনও করেনি। অভিজ্ঞতা আর নিজস্ব জনবলবিহীন এ জেলার পাঁচটি সংস্থাকে ইসি নিবন্ধন দিলেও এ কাজে বিদেশীরা অর্থ না দেওয়ায় একটি ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতীতের ন্যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবার আন্তর্জাতিক কোনো পর্যবেক্ষক সংস্থার দৃশ্যমান তৎপরতা নেই বিভাগীয় জেলা শহর খুলনায়। আবার বেশ কিছু ভিনদেশী সংস্থা নিবন্ধিত হলেও পর্যবেক্ষক পাঠানোর উদ্যোগ থেকে সরে গেছে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তথ্যমতে, খুলনা জেলা থেকে নিবন্ধিত পাঁচটি সংস্থার তালিকায় নাম রয়েছে ডেভেলপমেন্ট এডুকেশন এন্ড পীস, ডেভেলপমেন্ট অব মহিলা সোসাইটি (ডিএমএস), ওয়েসডা, নাইস ফাউন্ডেশন এবং উদ্ভাবনী মহিলা সংস্থার। খুলনা বিভাগের অন্যান্য জেলায় নিবন্ধিত সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে যশোরের সাতটি, ঝিনাইদহের দু’টি এবং চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের একটি সংস্থার নাম। তবে এ কাজে আগ্রহ দেখায়নি বিভাগের বাকি পাঁচ জেলার কোনো সংস্থা।
ইসি’র তালিকার সূত্র ধরে পর্যালোচনায় দেখা যায়, এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণে খুলনার যে পাঁচটি বেসরকারি সংস্থা ইসিতে নিবন্ধিত হয়েছে তার মধ্যে চারটিই নতুন। আর একটি সংস্থার ঝুলিতে রয়েছে একাদশ সংসদ নির্বাচনে মাত্র দু’টি আসনের ভোট পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতার। বাকি তিনটি সংস্থা রয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তার একদিনের প্রশিক্ষণ আর গাইডলাইনের অপেক্ষায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জেলার নিবন্ধিত পাঁচটি সংস্থার মধ্যে ডিএমএস দাতা সংস্থার সহযোগিতা না পাওয়ায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এমনটি স্বীকারও করেছেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফৌজিয়া জেসমিন রিনা। অপর যে চারটি সংস্থা কাগজে কলমে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চাইছে তার মধ্যে ওয়েসডার নির্বাহী পরিচালক শেখ মো: মারুফুল হক ৫০জনের একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছেন বলে জানালেও শেষ পর্যন্ত তারা পর্যবেক্ষণের কাজ করতে পারবে কি না তা’ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
অপর সংস্থা নাইস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মজিবর রহমান জানিয়েছেন ‘যেহেতু নিবন্ধন পেয়েছি সেহেতু পর্যবেক্ষক না দিলে নয়। তাই ১২জনের তালিকা তৈরী করা হয়েছে’। এ সংস্থাটির সমন্বয়কারী বাবলুজ্জামান জানান, ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষনে আমাদের সংস্থা এবারই প্রথম অংশ নিতে যাচ্ছে’। পর্যবেক্ষণের কৌশল জানতে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রশিক্ষণের অপেক্ষায় রয়েছেন বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া কাজে নামার আগেই একটি সংস্থার বিরুদ্ধে উঠেছে পক্ষপাতমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিযোগ।
নাম পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে জেলার প্রাচীন একটি বেসরকারী সংস্থার শীর্ষ নির্বাহী বলেন, নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের কেউ কেউ কোন না কোন দলের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত। এজন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কতটা নিরপেক্ষ হবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
খুলনার বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষনের অভিজ্ঞ বেসরকারি সংস্থা ‘রূপান্তর’। সংস্থাটিও এবার নেই পর্যবেক্ষণে। কারণ জানতে চাইলে রূপান্তরের তথ্য কর্মকর্তা ম. আব্দুল হালিম বলেন, এটি একটি জটিল বিষয়। পর্যবেক্ষণ হবে নিরপেক্ষভাবে। সেখানে বিভিন্ন সংস্থা যেভাবে তদন্ত করে তাতে আর পর্যবেক্ষনের মানসিকতা থাকে না। এজন্য তারা এবার নিবন্ধনের জন্য আবেদনও করেননি।
এছাড়া সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষনে প্রথমদিকে উদ্যোগী হলে অনুকূল পরিবেশ না থাকার অভিযোগ এনে পরে সরে দাঁড়িয়েছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষনের সার্বিক বিষয় নিয়ে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপচারিতায় সুজন’র খুলনা বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এড. কুদরত-ই-খুদা বলেন, যাদের প্রতি জনগণের আস্থা আছে তারাই কেবল নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যোগ্য। তবে এবার যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে তাতে নির্বাচনের সঠিক চিত্র ফুটে না ওঠারও আশংকা রয়েছে। তাছাড়া দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে ডামি প্রার্থী দেওয়া হয়েছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখানোর জন্য।
তিনি আরও বলেন, জানিপপসহ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অনেক সংস্থাই এবার নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নেই। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাদের পরিচিতি নেই তাদের দিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করানো হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং এসব পর্যবেক্ষকরা কোন কোন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে পারে বলেও তার আশংকা।
সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক খুলনার প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, পর্যবেক্ষণের জন্য কোন সংস্থা বা ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হলে নিরপেক্ষতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে হয়। এবার খুলনায় যে পাঁচটি সংস্থাকে পর্যবেক্ষণের জন্য নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে তারা যেহেতু একেবারেই নতুন সেহেতু তাদের ব্যাপারে যেমন গ্রহণযোগ্যতার অভাব রয়েছে তেমনি রয়েছে দক্ষতারও অভাব। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তার কোনো সংস্থাই নেই এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের হিসাব অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরের ২৯টিসহ দুই ধাপে এবার মোট ৯২টি সংস্থাকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষনের জন্য নিবন্ধন দিয়েছে।
অবশ্য স্থানীয় পর্যবেক্ষণ সংস্থার ব্যাপারে খুলনার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ হুমায়ুন কবির বলেন, এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশন থেকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কমিশন থেকে রিটার্নিং অফিসারকে যেভাবে নির্দেশনা দেয়া হবে সেভাবেই তিনি কাজ করবেন বলেও জানান তিনি।
খুলনার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে একটি গাইডলাইন ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। তার আলোকেই তারা পর্যবেক্ষণ করবে। এর পরেও কোন প্রশিক্ষণের নির্দেশনা কমিশন থেকে আসলে সে আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।