দক্ষিণাঞ্চল হবে আধুনিক বাংলাদেশের একটি বিকাশমান জনপদ

ফারুক আহমেদ ঃ পদ্মা বহুমুখী সেতুর রূপকল্প এখন বাস্তব। আগামী বছরের মাঝামাঝি সেতুটি খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত। সেতুর রেলপথও খুলে যাবে ঐ বছরের শেষের দিকে। মূলত দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানী ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগের বন্ধন রচনা করেছে এ সেতু। পদ্মার প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে এখন রচিত হয়েছে এগিয়ে যাওয়ার মহাসড়ক। এখন প্রশ্ন-এরপর কী, হোয়াট নেক্সট? পদ্মাসেতুর পরে কী?
এ বিষয়ে একটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া উচিত যে, পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি কার্যত বৈষম্যের জনপদ দক্ষিণাঞ্চলের মৌলিক উন্নয়নের সূতিকাগার যাকে প্রবহমান নদীর ‘মূল ¯্রােত’ বলা যায়। এ মূল ¯্রােতকে বেগবান রাখতে ‘আন্তস্রোতের’ আবির্ভাব ঘটাতে হবে। অর্থাৎ আন্তস্রোত হিসেবে আরও কিছু সহযোগী প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তা’ হলে মূল ¯্রােতের স্থায়িত্ব এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ পদ্মাসেতুর সবচেয়ে ভাল ফল (ঙঢ়ঃরসঁস জবংঁষঃ) পেতে হলে আরও কিছু প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। যেগুলি বাস্তবায়ন করা গেলে ‘নতুন খুলনার’ আর্বিভাব ঘটবে। উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে-শিল্পে-বিনিয়োগে-যাতায়াতে-যোগাযোগে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। সার্বিক অর্থে দক্ষিণাঞ্চল পরিণত হবে আধুনিক বাংলাদেশের একটি বিকাশমান জনপদে।
পদ্মাসেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নিরীক্ষায় মোংলা বন্দর কার্যকরে এ সেতুর যৌক্তিকতা কি মাত্রায় হবে তা’ নির্ধারণে দেখা গিয়েছিল-পদ্মানদীতে সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে মোংলার সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা গেলে বন্দর ব্যবহারের উপযোগিতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। সে বিবেচনায় পদ্মাসেতু বাস্তবায়নের সমান্তরালে মোংলা পোর্টের সাথে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ সহজ, সাশ্রয়ী এবং নির্বিঘœ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে রেলপথ নির্মিত হচ্ছে, রাজধানী ঢাকা হতে মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত আন্তর্জাতিকমানের ও খুবই ব্যয়বহুল এবং উচ্চমানের সড়ক নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ফরিদপুরের ভাঙ্গা হতে মোংলা পর্যন্ত মহাসড়কটি ৪ লেনে উন্নীতকরণের কাজ এখনও হাতে নেয়া হয়নি। যেটি খুব জরুরী এখনই। কারণ পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পরপরই বিদ্যমান এ সড়কে যানবাহনের চাপ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে অল্প সময়ের মধ্যেই। সে কারণে গাড়ির ভবিষ্যতের চাপ সামলাতে এবং পোর্টের চাহিদা বিবেচনায় এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরী। যার ফলে এই বন্দরের ব্যবহার বাড়বে। ফলশ্রুতিতে খুলনার মানুষের সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে এই সেতু বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর চেয়েও বেশী ভূমিকা রাখবে।
খুলনার সমন্বিত উন্নয়নে পদ্মাসেতুর ভূমিকা অগ্রগন্য হলেও এর সাথে ওতপ্রোতভাবে খুলনায় পাইপলাইনে গ্যাস এবং খানজাহান আলী বিমান বন্দর প্রকল্প দুইটির বাস্তবায়ন জড়িত। কারণ পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ প্রকল্পটির মাধ্যমে খুলনা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে গ্যাস সরবরাহের কার্যক্রম শুরু হলে সাশ্রীয় জ্বালানীর সুবিধা গ্রহণ করে এখানে বিদ্যমান শিল্পগুলিতে আবার প্রাণের সঞ্চার হবে। একই সাথে গ্যাসনির্ভর নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাটশিল্প, বস্ত্রশিল্প, পোশাকশিল্প, সিরামিকসহ নানা ধরনের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার হবে। শিল্পের শহর খুলনা আবার হারানো যৌবন ফিরে পাবে।
খুলনাঞ্চলে খানজাহান আলী বিমান বন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্ব অসীম। খুলনায় বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো, মোংলা ইপিজেড, মোংলা সমুদ্র বন্দর এবং বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পের প্রসারসহ রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের সাথে সহজ যোগাযোগ সৃষ্টির জন্য খুলনার খানজাহান আলী বিমান বন্দর প্রকল্পটি খুলনার সমন্বিত উন্নয়নের অন্যতম সূচক। কারণ সহজ উন্নয়ন অবকাঠামো বর্তমান বিশ্বের প্রধান অগ্রাধিকার। দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই উন্নয়নের পশ্চাদভূমি হিসেবে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে মনে করলে খুলনায় বিমানবন্দর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। মোংলা পোর্টকে পদ্মাসেতুর মাধ্যমে ‘সড়ক পথে’ ও খানজাহান আলী বিমান বন্দরের মাধ্যমে ‘আকাশ পথে’ সরাসরি সংযুক্ত করতে পারলে এবং পোর্টের চলমান নাব্যতা সংকট নিয়মিত ব্যবস্থাপনায় আনা গেলে খুলনাঞ্চলে মোংলাপোর্টকেন্দ্রিক সমন্বিত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক নিশ্চিত সম্ভব হবে। কারণ পদ্মাসেতু এবং মোংলা পোর্ট- এ দুটি স্থাপনা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চমক দেখাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনি অবস্থায় দূরদর্শী পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তবায়নের ‘সেনাপতি’ খুঁজে পাওয়া গেলে বৈষম্যের জনপদে ‘নতুন খুলনার’ আর্বিভাব হবে।
বাস্তবায়নাধীন পদ্মাসেতুর কারণে দীর্ঘকালের উন্নয়নবঞ্চিত খুলনার সামনে এখন অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির সুর্বণ সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। এ কারণে পদ্মাসেতুর পাশাপাশি শিল্পকারখানায় ব্যাপকভাবে পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ এবং বিমান বন্দর প্রকল্প দুটিও বাস্তবায়ন এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। এ কারণে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল, খুলনাঞ্চলের রাজনীতিক এবং সুশীলসমাজসহ খুলনার সুষম উন্নয়নে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দকে ‘ভবিষ্যত খুলনা’ সাজাতে এখনই সুদূরপ্রসারী এবং সময়োপযোগী উন্নয়ন ভাবনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নবঞ্চিত হয় খুলনা। দেশের অপরাপর বিভাগীয় শহরগুলির উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় চরমভাবে ছিটকে পড়ে খুলনা। একপেশে উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক আশির্বাদপুষ্ট উন্নয়নের ঘেরাটোপে খুলনা হারিয়ে যায়। ক্রমেই খুলনার আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। শিল্প নগরীর ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়। দুর্দাড় করে বৃহৎ শিল্পগুলি বন্ধ হতে হতে খুলনা কার্যত একটি মৃতনগরীতে পরিণত হয়। এর ফলে খুলনার শিল্পের প্রাণস্পন্দন পুরোপুরিভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে রাজনীতিকদের চোখের সামনে। লক্ষ মানুষ কর্মচ্যুত হয়। বন্দর এবং শিল্পনির্ভর অর্থনীতি মুখ থুবরে পড়ে। আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে চরম অস্থিতি এবং মন্দা দেখা দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়ন সকল কিছুতে এক চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় সৃষ্টি হয়। কিন্তু আশার কথা, এখন ক্রমেই অবস্থা পালটাচ্ছে। পদ্মা সেতুকে নিয়ে মানুষ আবার আশায় বুক বাঁধছে। খুলনাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরী হচ্ছে। যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সহজ ও সাশ্রয়ী হচ্ছে। খুলনা শিল্পের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার আবহ তৈরী হচ্ছে। এখন শুধু দরকার টার্গেট নির্ধারণপূর্বক বাস্তবসম্মত কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও স্বচ্ছতার সাথে তা’ বাস্তবায়ন-অভিমত পর্যবেক্ষক মহলের।