খুলনার কামার পাড়ায় শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা
মাশরুর মুর্শেদ : ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই প্রস্তুতি। আর কোরবানির ঈদ মানে পশু জবাই ও মাংস কাটার প্রস্তুতি । আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক প্রাচীন শিল্প কামারশিল্প। খুলনার ফুলতলা উপজেলার বাজার ঘেঁষে অবস্থিত কামারপাড়াসহ দৌলতপুর, খানজাহান আলী থানার কামারের দোকানগুলি ব্যস্ত সময় পার করছে। সকাল হতেই শুরু হয় কামারদের কাজ, থামে গভীর রাতে। পুরো পাড়া টুং-টাং শব্দে মুখর থাকে সারাদিন।
দৌলতপুরের কামারশিল্পী তপন কর্মকার জীবনের চার দশক কাটিয়েছেন লোহা পেটাতে পেটাতে। ঈদের আগে এই সময়টাই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়টা আমাদের রোজগারের সময়। বাকি সময় কামাররা বসে থাকে। তাই নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করি, ক্লান্ত চোখে বললেন তিনি। তবে তিনি হতাশার সুরে জানালেন এবারের ঈদে চাপ কম।
তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল হৃদয় কর্মকার, ভাই এর সাথে একই পেশায় নিয়োজিত। তিনি বললেন,আমার বন্ধুরা কেউ দোকানে,কেউ মোবাইল সার্ভিসিং করে। কিন্তু আমি চাইছি বাবার কাজটা ধরে রাখতে। তবে সারা বছর কাজ থাকলে ভালো হতো।
কয়লার চুল্লি। তার ওপরে গরম হচ্ছে লোহা। হাপর টেনে বাতাস দিচ্ছেন একজন, আরেকজন ভারী হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছেন সেই লাল হয়ে ওঠা ইস্পাতের খন্ড। পাশেই একজন শান দিচ্ছেন পুরনো চাপাতিতে।
কামারের দোকানগুলিতে নারী সদস্যরাও বসে আছেন কোণায়, ছুরি ও চাপাতির হাতল বাঁধছেন নারকেলের ছোবড়া আর কাপড় দিয়ে। প্রীতিরানী, একজন বৃদ্ধা বলেন, স্বামীর সঙ্গে কাজ করি ছোটবেলা থেকে। মেয়েদেরও এ কাজ শিখিয়ে দিচ্ছি। ঈদের আগে আমাদের কামারপাড়া যেন বিয়ে বাড়ির মতো ব্যস্ত থাকে।
ঈদের সময় একেকজন কারিগরকে দিনে ২০-৩০টি ছুরি, দা বা চাপাতি তৈরি করতে হয়। অনেকেই অর্ডার দিয়ে যান আগে থেকেই। দাম নির্ভর করে ডিজাইন, শান ও কাজের মানের উপর।
এই সময় বাজারে দা বিক্রি হয় ৪০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। ছুরি ২০০-৬০০ টাকায়। মানুষ এখনো কামারের তৈরি জিনিসে ভরসা রাখে। এই বিশ্বাসটাই আমাদের টিকিয়ে রেখেছে।
এই শিল্প শুধু পেশা নয়, এটি বাংলার গ্রামীন সংস্কৃতিরই অংশ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সারা বছর কাজ না থাকায় নতুন প্রজন্ম অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। খুলনায় কামারশিল্প একটি পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, তবে এটি দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। সুনির্দিষ্ট সরকারি পরিসংখ্যান না থাকলেও খুলনা জেলায় আনুমানিক ৭০০ থেকে ১২০০টি পরিবার এখনো কামারশিল্পের সঙ্গে আংশিক বা পূর্ণকালীনভাবে জড়িত। এর মধ্যে দৌলতপুর, ফুলতলা, রূপসা, খানজাহান আলী ও পাইকগাছা উপজেলায় এই সংখ্যাটি তুলনামূলক বেশি। ফুলতলা উপজেলার বাজার সংলগ্ন কামারপাড়া, রূপসা ঘাট এলাকা, ও বটিয়াঘাটা ইউনিয়নে এখনো সক্রিয়ভাবে কামারদের কর্মযজ্ঞ দেখা যায়। ২০-২৫ বছর আগেও খুলনাজুড়ে প্রায় ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ পরিবার এই পেশায় ছিল। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্লাস্টিক-পারিবারিক পণ্যের আগ্রাসনে, এবং সারাবছর কাজ না থাকায় অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। কোরবানির ঈদের সময় চাহিদা বেড়ে যায় এবং অনেক পরিবার মৌসুমভিত্তিক কামার কাজ করেন। অনেক পরিবার এখন গৃহকর্ম, দিনমজুরি, কিংবা ছোট ব্যবসার সঙ্গে কামারপেশাকে মিশিয়ে টিকে আছেন। কামারপাড়ার প্রবীণ সদস্য মতিয়ার রহমান বলেন,আগে পুরো পাড়া জুড়ে ৪০-৫০টা পরিবার কামারের কাজ করতো। এখন তা কমে ১৫-২০টায় নেমে এসেছে। সরকার যদি প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিত, তাহলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারতাম।
তবে ঐতিহ্যবাহী কামার শিল্প আজ সময়ের চাহিদায় রূপ নিচ্ছে আধুনিকতায়। প্রচলিত হস্তচালিত পদ্ধতির পরিবর্তে এখন এই শিল্পে ঢুকছে আধুনিক যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রিক ফার্নেস, উন্নত স্টিল, এমনকি ডিজিটাল বিপণন পদ্ধতি। খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন কামারের দোকানে এরই মধ্যে এর স্পষ্ট প্রভাব দেখা যাচ্ছে। একসময় লোহা পুড়িয়ে, হাতুড়ি পেটানো ছিল কামারদের প্রধান পদ্ধতি। এখন অনেকেই ব্যবহার করছেন বিদ্যুৎচালিত কাটার, গ্রাইন্ডার, প্রেসার হ্যামার এবং গ্যাসচালিত চুল্লি। সময় বাঁচে, উৎপাদন বাড়ে, খরচও কম পড়ে।
খুলনার তেরখাদা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের কামার আব্দুল কুদ্দুস জানান, আগে দিনে তিনটা কোদাল বানাতাম, এখন মেশিন দিয়ে আট-দশটা হয়। শারীরিক কষ্টও কম।
আগে যেখানে কেবল কৃষিকাজের কোদাল, হাসুয়া, দা বানানো হতো, এখন তৈরি হচ্ছে কারিগরি সরঞ্জাম, ছুরি সেট, এমনকি শিল্প কারখানার কিছু যন্ত্রাংশ। ক্রেতারা এখন টেকসই ও নান্দনিক পণ্য চান, যার জোগান দিতে কামাররা রঙ ও পালিশ প্রযুক্তিও শিখছেন। কামাররা এখন কেবল হাটে বসে নয়, ফেসবুক পেইজ, অনলাইন মার্কেটপ্লেসেও পণ্য বিক্রি করছেন। খুলনার ডুমুরিয়ার কামার মেহেদী হাসান বলেন, আমার একার পণ্য এখন চট্টগ্রাম, রাজশাহীতেও যাচ্ছে। অনলাইনেই অর্ডার পাই।
তবে শিল্পটিতে টেকসই রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ, আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রাপ্তি এবং বাজারে প্রবেশের সুবিধা। অনেক কামারই জানান, তারা এখনও পর্যাপ্ত অর্থসহায়তা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছেন।
খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেকানিক্যাল বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন এই শিল্পকে আধুনিক করতে হলে প্রযুক্তির হালনাগাদ, ডিজাইন উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ দরকার।
কোরবানির ঈদে যে ছুরি আমাদের হাতে ধরা পড়ে, তার পেছনে আছে একটি হাতুড়ি-পেটানো জীবনের গল্প। কামারদের ঘামে, আগুনে, ও সংকল্পে তৈরি সেই সরঞ্জাম আমাদের উৎসবকে পরিপূর্ণ করে। তবুও, শহর আর বাজার যত আধুনিক হয়, ততই এই প্রাচীন শিল্পগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে পড়ে। কামারপাড়ার টুং-টাং শব্দ যেন কেবল ঈদের প্রস্তুতি নয়, বরং একটি ঐতিহ্য ও জীবিকার টিকে থাকার জন্য প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি।