খুলনা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অতিবৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত
বিল ডাকাতিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
খুলনায় টানা ভারী বৃষ্টিপাত আর নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ডুমুরিয়া ও পাইকগাছা। কয়রা, তেরোখাদা, রূপসা ও দিঘলিয়াও রয়েছে ক্ষতিগ্রস্থের তালিকায়। চলতি বর্ষণে পাইকগাছা উপজেলার প্রায় ২ হাজার ৮৫০টি চিংড়ি ঘের এবং ৯০০টি পুকুর পানিতে তলিয়ে গিয়ে মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিল ডাকাতিয়া ও মধুগ্রামের নিম্নাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ চাষযোগ্য এলাকা তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধতায় কৃষক ও মৎস্যজীবীরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়ার নিম্নাঞ্চল আবারও পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে মাছের ঘের, সবজি ক্ষেত ও বসতভিটা ডুবে গিয়ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষিরা। অতি বৃষ্টিতে মোংলা বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রাখা হয়েছে। গত কয়েক দিনের ধারাবাহিক বৃষ্টিতে খুলনা শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি দপ্তর এমনকি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড রুমও পানিতে তলিয়ে গেছে। ধসে পড়েছে শতবর্ষ পুরোনো ছাদের অংশ।
আমাদের শাহপুর (খুলনা) সংবাদদাতা জানান, চলতি মৌসুমের টানা অতিবৃষ্টিতে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিল ডাকাতিয়ার নিম্নাঞ্চল আবারও পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে মাছের ঘের, সবজি ক্ষেত ও বসতভিটা ডুবে গিয়ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষিরা। শোলমারী স্লুইজ গেটে স্থাপিত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জার্মান সাবমার্সিবল মোটর দিয়েও আশানুরূপ পানি নিষ্কাশন সম্ভব হয়নি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল হিসেবে পরিচিত ১৪ হাজার ৩০০ হেক্টর আয়তনের বিল ডাকাতিয়া খুলনা ও যশোর জেলার কয়েকটি উপজেলার মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। গত বছর অতি বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল এই অঞ্চলে। চাষিরা সেসময়ের ক্ষতি পুষিয়ে উঠার আগেই এবারও টানা বর্ষণে নতুন করে ডুবেছে মাছের ঘের ও সবজিক্ষেত।
রঘুনাথপুর ইউনিয়নের দেড়ুলী, কৃষ্ণনগর, রংপুর ইউনিয়নের বটবেড়া, মুজাগুটা, বারানশী, সাড়াভিটাসহ বিভিন্ন গ্রামের নিচু এলাকা ইতোমধ্যেই প্লাবিত হয়েছে। কৃষ্ণনগর গ্রামের চাষি তারক চন্দ্র মণ্ডল বলেন,প্রশাসন চেষ্টা করলেও ঘের পানির নিচে থাকায় বোরো ধান করতে পারিনি। এবারও একই অবস্থা। সবজি ও মাছের ঘের ৯০ ভাগই তলিয়ে গেছে। কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিল কমিটির সভাপতি অধ্যাপক জি এম আমান উল্লাহ এবং আদিত্য কুমার মণ্ডল জানান,শুধু নিচু এলাকা নয়, উঁচু এলাকাও এখন ডুবু ডুবু অবস্থায়। আরও ৩-৪টি মেশিন বসানো গেলে পানি দ্রুত সরানো যেতো। আন্দুলিয়া গ্রামের হেলাল গাজী জানান, তাঁর দুটি ঘের ও সবজিক্ষেত ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার ইনসাদ ইবনে আমিন জানান,অতিবৃষ্টির কারণে নিম্নাঞ্চলের কিছু ঘের ও সবজিক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে উঁচু এলাকা এখনও নিরাপদ। আরও বৃষ্টি হলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বাড়বে। ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আল আমিন বলেন,আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আরও মোটর বসানোর জন্য চেষ্টা চলছে। চাষিদের দাবি, অবিলম্বে পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, জরুরি ত্রাণ সহায়তা ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি নিতে হবে, তা না হলে বিল ডাকাতিয়ার জীবন নির্ভর অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
আমাদের পাইকগাছা অফিস জানায়, টানা তিন দিনের মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিপাতে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা পাইকগাছা। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার বিঘার চিংড়ি ঘের, পুকুর, কৃষি জমি, রাস্তা-ঘাট ও জলাশয়। জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, চলতি বর্ষণে উপজেলার প্রায় ২ হাজার ৮৫০টি চিংড়ি ঘের এবং ৯০০টি পুকুর পানিতে তলিয়ে গিয়ে মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক। এছাড়া বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে প্রায় ২শ’ হেক্টর জমির কৃষি ফসল। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ একরামুল হোসেন জানান, ভারি বর্ষণে ৮২ হেক্টর আমন বীজতলা, ১১৫ হেক্টর সবজি, ১৮ হেক্টর মরিচ ও ২ হেক্টর অফ-সিজন তরমুজ পানিতে ডুবে গেছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে আরও সময় লাগবে বলে তিনি জানান। উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের চেঁচুয়া গ্রামের দিনমজুর বাবর আলী বলেন, কাজে যেতে পারছি না। ঘরে বসে দিন কাটাতে হচ্ছে। সংসার চালানোই এখন কষ্টকর। পাইকগাছা পৌরসভা ও বিভিন্ন ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ সড়ক হাঁটু পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সরল, বাতিখালী, গোপালপুর ও শিববাড়ীসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখা দিয়েছে মারাত্মক জলাবদ্ধতা। উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাতায়াতের পথেও জমেছে হাঁটু পানি। বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই দিনের পর দিন থেমে থেমে বৃষ্টিতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষেরা পড়েছেন চরম দুরবস্থায়।এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহেরা নাজনীন জানান, আবহাওয়ার প্রভাব বিবেচনায় রেখে জলাবদ্ধতা নিরসনসহ জনদুর্ভোগ কমাতে উপজেলা প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আমাদের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি দিঘলিয়া থেকে জানান,গত তিন দিনের অতি বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারনে ৩শ হেক্টর জমির আউশধান, রোপা আমনের বীজতলা, বোনা আমান,পান, অফসিজনের তরমুজ ও সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।
নড়াগাতি (কালিয়া) নড়াইল প্রতিনিধি জানান, নড়াইল জেলার নড়াগাতী উপজেলার পহরডাঙ্গা, বাঐসোনা, কলাবাড়িয়া ও খাশিয়াল ইউনিয়নের একাধিক গ্রাম টানা কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দিনমজুর, কৃষক ও ভ্যানচালকরা। কাজকর্ম বন্ধ থাকায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল পানিতে প্লাবিত হওয়ায় ঘরবাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে পানি। রান্নাবান্না, চলাফেরা, এমনকি স্বাভাবিক ঘুমানোও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এক প্রকার পানির মধ্যে বসবাস করছেন স্থানীয়রা।পহরডাঙ্গা গ্রামের দিনমজুর নজাম মোল্লা বলেন, ভোরবেলা ঘুম ভাঙে বৃষ্টির শব্দে। সারাদিন পলিথিনের নিচে বসে কাটাতে হয়। কোনো কাজ নেই, পেটে ভাত দেবো কীভাবে?
দিনমজুর শ্রেণির মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারায় আয়ের পথ একেবারে বন্ধ। পরিবার-পরিজন নিয়ে কেউ কেউ আধা-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। জরুরি প্রয়োজনে কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জ শহরের দিকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ আশপাশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সুযোগও সীমিত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা সখিনা সখিদার জানান,প্রায় প্রতিটি ঘরে পানি উঠেছে। রান্না করা যাচ্ছে না, ঘুমানোর জায়গা নেই। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে শিশু, বৃদ্ধ আর গবাদিপশুরা।
পহরডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মল্লিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন,আমি নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি এবং পরিস্থিতি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি, যাতে দ্রুত সাহায্য পাঠানো হয়। এ অবস্থায় ভুক্তভোগীরা জরুরি খাদ্য সহায়তা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করেছেন।
এদিকে অতি বৃষ্টির কারনে মোংলা বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। বর্তমানে বন্দরে থাকা নয়টি পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রাখা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে উত্তাল আবহাওয়ার কারনে সাগরের মাছ ধরার ট্রলার গুলো সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে আশ্রয় নিয়েছে। ডিএফও রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সাগরে ঝড়ো হাওয়ায় নিরাপত্তার জন্য সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে শত শত মাছ ধরার ট্রলার আশ্রয় নিয়েছে।