এম মুর্শেদ: খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাধবকাটি গ্রামের সরু কাঁচা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শেষ হয়ে যায় শুকনো মাটি। এর পরেই শুরু হয় থৈ থৈ পানির বিস্তীর্ণ এলাকা। কোমর সমান পানির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা আকলিমা খাতুন। তিনি বললেন, জীবনে কত বন্যা দেখেছি। কিন্তু এ রকম পানিতে আটকা পড়িনি কখনও। বন্যার পানি একদিন না একদিন নেমে যায়। কিন্তু এই পানি মাসের পর মাস আটকে আছে। ঘরের ভেতরে চুলা জ্বলে না,সন্তানদের স্কুল হয় না। জমিতে ফসল নেই। আমরা বাঁচব কিভাবে?
আকলিমা খাতুনের এই করুন আর্তি আজ ডুমুরিয়ার লাখো মানুষের। খুলনার সবচেয়ে বড় এই উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম এখনো কোমর পানির নিচে ডুবে আছে। নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়া, স্লুইসগেটের মুখ বন্ধ থাকা এবং বছরের পর বছর নদী খাল খননের উদ্যোগ না নেওয়ার কারণে তৈরি হয়েছে এই জলাবদ্ধতা। পানিবন্দী গ্রামগুলো হলো, মুজারঘুটা, বারানসি, সাড়াভিটা, বটবেড়া, কৃষ্ণনগর, দেড়লি, বশিরাবাদ, আন্দুলিয়া, কোমরাইল,চেচুড়ি,কাটেঙ্গা,টোলনা,বরুনা,গজেন্দ্রপুর,রুপরামপুর,রামকৃষ্ণপুর,শান্তিনগর,ঘোনা,বিলপাটিয়ালা, মাধবকাটি, মান্দ্রা, ময়নাপুর, বিলসিংগা, রানাই, পাঁচপোতা, ঘোষড়া, বাদুড়িয়া, আলাদিপুর,আটলিয়া, বয়ারশিং, আধারমানিক, খড়িয়া, কোমলপুর, গুটুদিয়া, পাটকেলপোতা, মির্জাপুর, হাজিডাঙ্গা, গোলনা, খলসী, সাজিয়াড়া ও আরাজি ডুমুরিয়া।
এটি কোনো আকস্মিক বন্যা নয় এটি এক নীরব দুর্যোগ, যা এখানে বসবাসরত মানুষের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক জীবন সবকিছুকে পঙ্গু করে দিয়েছে।
মাধবকাটির কৃষক বিভাস চন্দ্রের চোখে জল এসে যায় নিজের জমির কথা বলতে গিয়ে। পাঁচ বিঘা জমি পানির নিচে। ধান চাষ করার কথা ছিল, বীজতলাও বানাতে পারিনি। ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। ব্যাংকের ঋণ শোধ দেব কি করে ? আমাদের সবকিছু পানিতে তলিয়ে গেছে।
ডুমুরিয়ার হাজার হাজার কৃষক আজ দিশেহারা। বর্ষা পেরিয়ে শরৎকালেও মাঠে ধান নেই, বীজতলা নেই, ঘেরে মাছ নেই। কৃষি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেকে গ্রামীণ এনজিওর ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রতিটি দিনের সূর্যোদয় যেন নতুন করে চিন্তায় ফেলছে খাবার জুটবে তো?
পাশেই সাজিয়াড়া আশ্রয়ন প্রকল্পে আরও এক চরম অমানবিক দৃশ্য । ৫৮টি ঘরের সবকটিই পানির নিচে। ঘরের মেঝে ডুবে আছে, দরজার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়েছে স্থির কালচে পানি। গৃহবধূ হাসিনা বেগম কাঁপা গলায় বললেন,ঘরের ভেতরে পানি। রান্না করার জায়গা নেই। মাচা বানিয়ে কোনোমতে বাচ্চাদের নিয়ে টিকে আছি। শুকনো খাবারেই দিন কাটছে। রাতে সাপ আসে, মশা কামড়ায়। আমাদের জীবনটা এখন পানির নিচে। এই প্রকল্পের পুরুষরা অনেকেই শহরে দিন মজুরের কাজে গিয়েছেন; নারীরাই এখানে বাচ্চাদের নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
জলাবদ্ধতা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে শিশুদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা। মাধবকাটি বিলপাটিয়ালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পুরোপুরি কোমরপানির নিচে তলিয়ে আছে। ইটের ভবনের দরজা পর্যন্ত কাদা-পানি। স্কুলের বেঞ্চ-টেবিল ভাসছে, ক্লাসরুমে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। স্কুল ভবনের চারপাশে পচা পানির মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়।
প্রধান শিক্ষক ভেজা প্যান্ট মুছতে মুছতে বলেন, দুই মাস ধরে স্কুল বন্ধ। আধা কিলোমিটার দূরে একটি পরিত্যক্ত মুরগির খামারে কোনোভাবে ক্লাস চালাচ্ছি। ৫৫ জন শিক্ষার্থী ভেজা মেঝেতে বসে পড়াশোনা করছে। এখন বাচ্চাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। কেউ কেউ আর আসেই না। একজন মা, অঞ্জলি রানী জানালেন,হাটু পানিতে ডুবে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাই। অনেক দিন ধরে মেয়েটা বাড়িতেই আছে। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমানও বিষয়টি স্বীকার করলেন,এলাকার অন্তত পাঁচ-ছয়টি বিদ্যালয় পানিতে ডুবে আছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেক কমে গেছে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব ভয়াবহ হবে।
শিশুদের অনেকেই ইতিমধ্যেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে, তাদের শরীরে পানিবাহিত রোগ দেখা দিচ্ছে,আর মনোজগতে জন্ম নিচ্ছে অদৃশ্য এক অনিশ্চয়তা।
পানিবন্দি গ্রাম গুলোতে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এখন রোগবালাই। পচা পানির দুর্গন্ধে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। গৃহবধূ সালমা খাতুন জানালেন,শিশুরা বারবার অসুস্থ হচ্ছে। ওষুধ কিনতে পারছি না। পরিষ্কার পানি নেই। টিউবওয়েলের চারপাশে পানি জমে গেছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কাজল মল্লিক বলেন,পরিষ্কার পানির সংকট ও স্যানিটেশনের অবনতির কারণে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে ডায়রিয়া, চর্মরোগ ও জ্বর দ্রুত ছড়াচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করতে হবে। স্থানীয় হাসপাতাল গুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে চর্মরোগ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, একসময় ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও বিলডাকাতিয়ার পানি শোলমারী ও হামকুড়া নদী দিয়ে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু হামকুড়া নদী পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে। শোলমারী নদীও পলি পড়ে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে ভরাট হয়ে গেছে আপার সালতা নদী।
পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন বলেন,গত কয়েক বছরে শোলমারী নদী খননে প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ টাকার কাজ শেষ হয়েছে, আরও ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার কাজ চলছে। একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাম্পও বসানো হয়েছে। তবে এগুলো স্থায়ী সমাধান নয়। এজন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসীর প্রশ্নএই প্রকল্প কবে বাস্তবায়ন হবে? কারণ বিগত এক দশকে অন্তত চার দফা প্রকল্পের আশ্বাস তারা শুনেছেন, কিন্তু পানিবন্দি জীবন থেকে মুক্তি পাননি।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন,অন্তত অর্ধশত গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে বিভিন্ন দপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মনে প্রশ্ন এই প্রকল্পগুলো বাস্তবে মাঠে কবে বাস্তবায়ন হবে ? তারা বলছেন, বর্ষা এলেই প্রতি বছর একই দৃশ্য বছরের পর বছর কেবল প্রকল্পের কাগজ ঘোরে, মাঠে কাজ নামে না।
এদিকে গত শনিবার জলাবদ্ধ পরিস্থিতি সরেজমিন ঘুরে দেখেন খুলনার জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান। মতবিনিময় সভা ও এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি জানান, দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘবে প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দ্রুত কাজ শুরু হলে স্থায়ী সমাধান মিলবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও বাপা খুলনা শাখার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন,ডুমুরিয়ার সমস্যা মূলত প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ভেঙে পড়া। নদী-খাল নিয়মিত খনন না হওয়ায় পানি আটকে আছে। এখানে একটি দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান জরুরি। পাম্প বসানো সাময়িক সমাধান, কিন্তু প্রকৃত সমাধান হলো নদী ও খালের প্রবাহ ফিরিয়ে আনা। তিনি বলেন, কেবল ডুমুরিয়া নয় খুলনার অন্যান্য এলাকাও একই সংকটের দিকে যাচ্ছে। এখনই বড় পরিকল্পনা না নিলে সমগ্র অঞ্চলের কৃষি ও বসতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
সবশেষে ভুক্তভোগী কৃষক আব্দুল মালেকের কণ্ঠেই ফুটে ওঠে ডুমুরিয়ার মানুষের হাহাকার আমরা ত্রাণ চাই না। আমাদের বাঁচতে হলে জমিতে ফসল ফলাতে হবে, মাছ চাষ করতে হবে। নদী খনন আর পানি নামার ব্যবস্থা করে দিন।একই সুর শোনা গেল বৃদ্ধা রাবেয়া বেগমের কণ্ঠেও একই সুর, আমাদের ঘর-বাড়ি, স্কুল, মসজিদ সব পানির নিচে। আমরা বাঁচতে চাই। এই পানি থেকে মুক্তি চাই।
ডুমুরিয়ার জলাবদ্ধতা কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় এটি প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা ও অবহেলার যৌথ ফল। কোটি কোটি টাকার অস্থায়ী কাজের প্রতিশ্রুতির ভেলায় বছর কেটে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। স্থায়ী সমাধান ছাড়া ডুমুরিয়ার মানুষ এভাবেই পানির নিচে বন্দি থেকে যাবে জীবনযাত্রা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি সবই ধ্বংস হবে। এখন সময় এসেছে কথার খাতা থেকে বের হয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার। নইলে ডুমুরিয়া কেবল মানচিত্রেই নয়, মানুষের মনে পানির নিচে বন্দি জনপদ হিসেবেই থেকে যাবে।