গৌরবের পদ্মা সেতু আর বাকি-২৪দিন

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ স্বপ্নের পদ্মাসেতু। গৌরবের পদ্মাসেতু। রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের সেতুবন্ধনের পদ্মাসেতু। আর মাত্র ২৪দিন পর উম্মুক্ত হচ্ছে ছয় দশমিক ১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ সেতুটি। পদ্মা নদীর ওপর মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সেতু চালু হলে পাল্টে যাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দৃশ্যপট। ভূমিকা রাখবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে। এমন মন্তব্য করে পদ্মাসেতুর দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসা সংগঠন বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, পদ্মাসেতুর দাবিতে খুলনাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলন হলেও সর্বশেষ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক প্রচেষ্টায়ই এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এজন্য তিনি প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণকে সামনে রেখে দৈনিক পূর্বাঞ্চলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
পদ্মাসেতু সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। আর পদ্মানদীর কারণে ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটি দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার প্রায় দু’কোটি মানুষ ছিল চরম বঞ্চিত। কিন্তু পদ্মাসেতুর মাধ্যমে সে বঞ্চনার অবসান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নের যে বঞ্চনা ছিল সেটিও দূর হবে। এক কথায় গোটা দেশ একটি ছাতার আওতায় এসে সম উন্নয়নের ধারা সূচিত হবে।
পদ্মাসেতু নিয়ে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, পদ্মাসেতুর দাবি ওঠার সাথে সাথে প্রথম যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল সেটি হচ্ছে মাওয়ার পরিবর্তে পাটুরিয়ায় সেতু করার পরিকল্পনা। তৎকালীন সময়ের একজন মন্ত্রীর এমন ঘোষণার সাথে সাথে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে সাথে নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। হরতাল, অবরোধসহ মাওয়া ঘাটেও মানব বন্ধন করা হয়। ওই আন্দোলনে এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরাও অংশ নিয়েছিলেন। যেটি হয়েছিল ২০০৪ সালে। এর আগে ২০০৩ সালে খুলনার শিল্প কলকারখানা বন্ধের প্রতিবাদ এবং মাওয়ায় পদ্মাসেতুর দাবিতে উন্নয়ন কমিটির ডাকে দু’দিনের হরতাল পালিত হয়েছিল। ওই সময় তিনিসহ অনেককে পুলিশ আটক করলে খুলনার আপামর জনসাধারণের বিক্ষোভের মুখে তাদেরকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
ওই আন্দোলনে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এবং যাদের অনুপ্রেরনায় পদ্মাসেতুর আন্দোলন সফল হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উন্নয়ন কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মরহুম আবু মহম্মদ ফেরদৌস, সাবেক এমপি এম, নূরুল ইসলাম, খুলনা বিভাগীয় প্রেসক্লাব ফেডারেশনের চেয়ারপার্সন আলহাজ¦ লিয়াকত আলী, খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির বালু, খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এড. ফিরোজ আহমেদ, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র আলহাজ¦ তালুকদার আব্দুল খালেক, সাবেক এমপি মরহুম এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা, সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি’র শাহেদ আলী রবি, বরিশালের শওকত আলী হিরণ, এড. মেজবাউল রাজন, ঝালকাঠির সুলতান হোসেন খান, মাদারীপুরের খোকা শিকদার ও হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
পরবর্তীতে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ^ব্যাংক, জাইকা এবং এডিবি। এছাড়া অনেকেই পদ্মাসেতু নিয়ে অনেক সমালোচনা-ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মবিশ^াস, আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ়চিত্তে দেশীয় অর্থায়নেই এ সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন।
পদ্মাসেতু চালু হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব যেমন বেড়ে যাবে তেমনি সচল হবে বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দরও। এ অঞ্চলের যেসব সম্পদ রয়েছে বিশেষ করে নারকেল, সুপারি, ডাবের পানি প্রসেসিং করে রপ্তানী করা সম্ভব হবে। মৎস্য সম্পদ, পাট, সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করেও রপ্তানীর সুযোগ সৃষ্টি হবে। সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। বেনাপোল থেকে কলকাতার দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার হলেও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থল বন্দর থেকে মাত্র ৬৮ কিলোমিটার। এজন্য ভোমরা স্থল বন্দরকে সচল করার মধ্যদিয়ে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের গুরুত্বও বাড়ানো সম্ভব হবে। যাতে পরিবহন খরচ ও জ¦ালানী ব্যয় কমবে। যা অর্থনীতিতে রাখবে এক যুগান্তকারী ভূমিকা। সেই সাথে এ অঞ্চলে তৈরি হবে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে উল্লেখ করে উন্নয়ন কমিটির সভাপতি বলেন, দীর্ঘদিনের যোগাযোগ দুর্ভোগ দূর হবে। রোগী পরিবহন ও ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন ছুটিতে মানুষের ভোগান্তি লাঘব হবে। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে গিয়ে রোগী মৃত্যুর মতো করুণ দৃশ্যও হয়তো আমাদের আর দেখতে হবে না। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক, যোগাযোগ ব্যবস্থায় এবং শিল্প বিপ্লবের এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে পদ্মাসেতুর মধ্যদিয়ে।
পদ্মাসেতুর পাশাপাশি সেখানে কয়েক মাসের মধ্যেই রেলসেতুও চালু হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রেলসেতুকে কার্যকর করতে খুলনার সাথে রেল যোগাযোগের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। তা না হলে খুলনার মানুষ রেলে ঢাকায় যাওয়ার পরিবর্তে সড়ক পথকেই বেশি প্রাধান্য দেবে। এছাড়া পদ্মাসেতুর পাশাপাশি খুলনার সাথে ঢাকার যোগাযোগ আরও সম্প্রসারিত করতে ফুলতলা থেকে নড়াইল ও গোপালগঞ্জ হয়ে মাওয়া সেতু পর্যন্ত এবং ভৈরব সেতুর মাধ্যমে দিঘলিয়া, তেরখাদা ও গোপালগঞ্জ হয়ে মাওয়া হয়ে ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হলে খুলনা-ফকিরহাট-গোপালঞ্জ-ঢাকা মহাসড়কের ওপর চাপ কমবে।
সর্বোপরি মাওয়ায় পদ্মাসেতু চালু হলে খুলনার সাথে সিলেট ও চট্টগ্রামের যোগাযোগেও এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন হবে বলে তিনি আশা করছেন। এতে ঢাকার ওপরও চাপ পড়বে না। কাঁচপুর ব্রীজ হয়ে ঢাকার বাইরে থেকেই যানবাহনগুলো সিলেট ও চট্টগ্রামে যেতে পারবে। তিনি পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে খুলনাঞ্চলের মানুষকে নানামুখি পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানান।