ভেঙে ফেলা হচ্ছে
পিকচার প্যালেস

এ এইচ হিমালয় : খুলনা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোর অন্যতম ‘পিকচার প্যালেস মোড়’। বিভিন্ন সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের জন্য এই মোড়টিকে বেছে নেয়। যে স্থাপনাকে কেন্দ্র করে এই মোড়ের নামকরণ, প্রায় আট দশকের পুরনো সেই ‘পিকচার প্যালেস’ হলটি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে।
এর আগে ডাকবাংলো মোড়ের নামকরণের স্মৃতিবিজড়িত শতবছরের পুরাতন ডাকবাংলো ভবনটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়। অনেকটা অবহেলাতেই শহর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পুরাতন সব ইতিহাস-ঐতিহ্য।
প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ১৯৪২ সালে নির্মিত ‘নীলা হল’টি ৪৭ এর দেশভাগের পর ‘পিকচার প্যালেস’ নামকরণ করা হয়। এরপর এই হলকে কেন্দ্র করে পরিচিতি পায় আশপাশের এলাকা। খুলনার বেশকিছু মার্কেট-শপিংমলসহ ব্যাংক, বীমা, সরকারি-বেসরকারি অফিস ও অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এই হলকে কেন্দ্র করে। সিনেমা ব্যবসা মন্দার কারণে গত এক দশক ধরে হলটি বন্ধ।
সম্প্রতি হল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অত্যন্ত গোপনে হল ভাঙার কাজ শুরু হয়। হলের বাইরের দোকানগুলো এখনও আগের মতোই রয়েছে। ভেতরের অংশের মূল হলটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। যার কারণে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, হল ভাঙা হচ্ছে।
॥ যেভাবে হলো পিকচার প্যালেস ॥
খুলনার বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক এইচ এম জামাল উদ্দিন জানান, চল্লিশের দশকে খুলনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন জমিদার শৈলেন চন্দ্র ঘোষ। তার মা একদিন ‘উল্লাসিনী’ সিনেমা হলে ছবি দেখতে গিয়েছিলেন। লাইনে দাঁড়িয়ে হলে প্রবেশ করতে তিনি অপমানিত বোধ করেন। বিষয়টি ছেলেকে জানানোর পর শৈলেন চন্দ্র ঘোষ ১৯৪২ সালে নিজেই একটি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করেন। মায়ের নামানুসারে সিনেমা হলের নাম দেওয়া হয় ‘নীলা হল’।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শৈলেন ঘোষরা সপরিবারে ভারতে চলে যান। তখন ভারত থেকে আসা দ্বীন মোহাম্মদ নামের এক অবাঙালীর সঙ্গে তাদের জমির মালিকানা বিনিময় হয়। পরবর্তীতে পীর মোহাম্মদরা ওই হলের নামকরণ করেন ‘পিকচার প্যালেস’। ক্রমেই ওই হলের সামনের স্থানটি পিকচার প্যালেস মোড় নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এখন খুলনা নগরীর অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা পিকচার প্যালেস মোড়।
খুলনার প্রবীণ নাগরিকরা জানান, ষাটের দশকেই পিকচার প্যালেস সিনেমা হলটি আধুনিকায়ন করে তাতে এসি ও সিনেমাস্কোপ পর্দা লাগানো হয়। প্রায় প্রতি শোতেই থাকতো ‘হাউসফুল’। কিছুদিন পর শুক্র ও রোববার সকাল সাড়ে ১০ টায় যোগ হয় মর্নিং শো। মর্নিং শোর ছবিগুলো ছিল ইংলিশ। মর্নিং শোর ছবিগুলোতে হাউসফুল হতো না। কিন্তু তারপরও মালিক নিয়ম করে ইংলিশ ছবি চালাতেন। বাংলা, হিন্দি ও পাকিস্তানী ছবির ভিড়ে ওই ইংলিশ ছবিগুলো খুলনার মানুষের জন্য ছিল বাইরের পৃথিবীর একটা খোলা জানালা।
॥ হলের স্থানে হবে বাণিজ্যিক ভবন ॥
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে হলটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। হল ভেঙ্গে সেখানে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন নতুন মালিকপক্ষ। ইতোমধ্যে মূল হলটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বাকি অংশ ভাঙার বিষয়ে বাধ সেধেছে জেলা প্রশাসন। হলের জমিতে সৈয়দপুর ট্রাস্টের (হাজী মুহাম্মদ মহসিন) সম্পত্তি রয়েছে, এমন দাবিতে মামলা করেছে জেলা প্রশাসন। আপাতত ভাঙার কাজ স্থগিত রয়েছে।
হল ভবনের ভেতরের অংশের কিছুটা জায়গা ইজারা নিয়ে মটরসাইকেল রাখার গ্যারেজ করেছেন মো. খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, মালিকপক্ষ জমিটি একটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়েছে। এখানে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন হবে। দ্বিতীয় তলায় একটি সিনেপ্লেক্স হবে। এমন পরিকল্পনার কথা তারা শুনেছেন।
তিনি বলেন, পিকচার প্যালেস সিনেমা হলের সঙ্গে তিনি জড়িত প্রায় ৩০ বছর ধরে। আগে হলের বাইরে তার একটি দোকান ছিলো, হল ভাঙার কাজ শুরু হলে ফাঁকা অংশ তিনি গ্যারেজ হিসেবে ভাড়া নিয়েছেন। গত নভেম্বর মাসে হল ভাঙার কাজ শুরু হয়। ডিসেম্বর মাসে জেলা প্রশাসনের লোক এসে হল ভাঙার কাজ বন্ধ করে দেয়। এখন ভাঙাভাঙির কাজ বন্ধ।
জানা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে হলের কিছু জমি সরাসরি, কিছু জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য বিক্রি করেছেন দ্বীন মোহাম্মদের পরিবারের সদস্যরা। প্রাসাদ নির্মাণ প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করবে। প্রতিষ্ঠানের মালিক ড. আবু ইউসুফ মোঃ আবদুল্লাহ।
॥ হারাধানের ছেলেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে ॥
১৯৩৬ সালে বড় বাজারের এক ব্যবসায়ী খুলনায় প্রথম উল্লাসিনী সিনেমা হল নির্মাণ করেন। পরে নির্মাণ করা হয় ‘নীলা হল বা পিকচার প্যালেস’। এরপর নগরীতে সোসাইটি, চিত্রালী, লিবার্টি, স্টার, ঝিনুক, সঙ্গীতা, বৈকালী, চিত্রালী, মিনাক্ষী, জনতা, সাগরিকা, গ্যারিসন ও শঙ্খ সিনেমা হল গড়ে ওঠে।
গত এক দশকে বন্ধ হয়ে গেছে উল্লাসিনী, মিনাক্ষী, পিকচার প্যালেস, স্টার, জনতা, সাগরিকা ও বৈকালী সিনেমা হল।
এর মধ্যে বৈকালী হলের স্থানে ৫ তারকা হোটেল নির্মাণ কাজ চলছে। স্টার হলটি ভেঙ্গে স্থান ফাঁকা করা হয়েছে। বর্তমানে ভাঙা হচ্ছে পিকচার প্যালেস সিনেমা হল।
খুলনার ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটির সদস্য সচিব মহেন্দ্রনাথ সেন বলেন, একটি শহরের প্রাণ হচ্ছে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরাতন সব স্থাপনা। নগরীর ডাকবাংলো ও পিকচার প্যালেস হলকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। কয়েক বছর আগে ডাকবাংলোটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এখন ভাঙা হচ্ছে হল। দায়িত্বশীলদের উচিত পুরাতন এসব স্থাপনা সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়া।