চাহিদা বেশি
সরবরাহ কম

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের নাজিম মোল্লা গতকাল রোববার দুপুরে নগরীর হেরাজ মার্কেটে আসেন এক পাতা নাপা এক্সট্রা কিনতে। কয়েক দোকান ঘুরেও যখন পাচ্ছিলেন না তখন অনেকটা হতাশ হয়েই ফিরছিলেন। শেষ পর্যন্ত এক দোকানে পেয়ে গেলেন কাক্সিক্ষত ওষুধটি। কি কারণে নাপা এক্সট্রা কিনছেন জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘মা নিতে বলেছেন’। ‘কেন ঘরে কারো জ¦র-কাশি হয়েছে’ এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘না, এমনিতেই ঘরে রেখে দেয়ার জন্য, যদি প্রয়োজন হয় তাই’। ‘নাপা এক্সট্রা ছাড়াওতো প্যারাসিটামল গ্রুপের অন্য ওষুধ আছে, কিন্তু শুধু নাপা এক্সট্রার জন্য ঘুরছেন কেনো’ জানতে চাইলে তার সাফ জবাব ‘নাপা এক্সট্রাই লাগবে’।
এভাবেই মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটে বেড়াচ্ছেন নাপা বা নাপা এক্সট্রার পেছনে। অথচ বাজারে প্যারাসিটামল গ্রুপের অন্য সব ওষুধই রয়েছে। সামান্য জ¦র-সর্দি-কাশি হলেই মানুষ অহরহ কিনে খাচ্ছেন ‘নাপা’ নামের ওষুধটি। কখনও জ¦র-কারি হতে পারে এমন আশংকায়ও কিনে রাখা হচ্ছে ওই ওষুধটি। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে প্যারাসিটামল গ্রুপের এই ট্যাবলেটটির কদর বেড়েছে অনেক। আবার এটি একটি ওটিসি(ওভার দ্য কাউন্টার) ওষুধ হওয়ায় এজন্য কোন প্রেসক্রিপশনেরও প্রয়োজন হয় না। ফার্মেসীগুলো থেকে কেমিষ্টরা বিনা প্রেসক্রিপশনে যেসব ওষুধ বিক্রি করতে পারেন তার মধ্যে অন্যতম একটি গ্রুপ হচ্ছে প্যারাসিটামল। ওই গ্রুপেরই একটি ওষুধ ‘নাপা’। নাপা ওষুধটি যে কোম্পানীর সেই কোম্পানী অর্থাৎ বেক্সিমকোর আঞ্চলিক বিক্রয় ব্যবস্থাপক(আরএসএম) মো: আজিজুল হক বললেন, এটি একটি ফ্যামিলি প্রোডাক্টে পরিণত হয়েছে। যে কারণে সকলেই এটি কিনে রাখছেন। প্রথমত করোনাকালীন সময়ে যেমন এর চাহিদা বেড়েছে তেমনি বর্তমান মৌসুমে প্রায় প্রতিটি ঘরেই সর্দি-কাশি-জ¦রে আক্রান্ত মানুষ রয়েছেন। সে কারণে সবাই এটি কেনার ফলে চাহিদা বেড়ে গেছে। তবে দ্রুতই এর সমাধান হবে বলে আশা করছেন তিনি।
রূপসার সামন্তসেনা এলাকার একজন ওষুধ ব্যবসায়ী জাফর সর্দার। বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে ওষুধের ব্যবসা করছেন ওই এলাকায়। অভিজ্ঞ ওই ওষুধ ব্যবসায়ীর সাথেও গতকাল কথা হয় হেরাজ মার্কেটে বসে। হঠাৎ করে নাপা’র এতো সংকট কেন জানতে চাইলে তিনি বললেন, নাপার প্রচার বেশি। ক্রেতাদেরকে প্যারাসিটামল গ্রুপের অন্য ওষুধ দিলে নিতে চায় না। তিনি বলেন, ক্রেতারা এটিকে একটি ‘ব্রান্ড’ তৈরি করে ফেলেছে। অথচ তার ভাষায় নাপা’র চেয়ে অনেক ভালো ভালো ওষুধ রয়েছে বাজারে।
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করলেন ওষুধ অধিদপ্তর, খুলনার সহকারী পরিচালক মো: মনির উদ্দিন আহমেদও। তিনি বলেন, বাজারে প্যারাসিটামলের কোন সংকট নেই। শুধুমাত্র নাপা’র কিছুটা সংকট রয়েছে এমন প্রচারের পর সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর সাথে তিনি কথা বলেছেন। কোম্পানীর পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়েছে যে, দ্রুতই সংকট কেটে যাবে। তিনি বলেন, আসলে মানুষ প্যারাসিটামল বলতে নাপাকেই বোঝে। অথচ প্যারাসিটামল গ্রুপের আরও অনেক ভালো ভালো ওষুধ বাজারে রয়েছে। জনসাধারণ বুঝলে আসলে এর কোন সংকট থাকে না। মানুষ যদি বুঝে তাহলে অন্যান্য ওষুধ কিনে প্রয়োজন মেটাতে পারে।
প্যারাসিটামল গ্রুপের অন্যান্য ওষুধ বাজারে থাকলেও নাপার প্রতি মানুষের কেন এতো দুর্বলতা জানতে চাইলে হেরাজ মার্কেটের সুমন মেডিকেল হলের সুমন বলেন, এটি আসলে ভার্চুয়াল প্রচারণার কারনে হয়েছে। করোনার শুরুর সময় কেউ হয়তো করোনার চিকিৎসার জন্য কয়েকটি ওষুধের নাম লিখে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর মানুষ ওইটি মুখস্ত করে রেখেছে। যে কারণে অন্য কোম্পানীর ওষুধ বাজারে অহরহ থাকলেও তা কিনতে নারাজ। এটি আসলে মানুষের মানসিক সমস্যা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্যারসিটামল গ্রুপের কয়েকটি ওষুধের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এইস, এইস প্লাস, এক্সপা এক্সআর, পল প্লাস, সেফোডিন, ফাস্ট, ফাস্ট প্লাস, এইস এক্সআর, এক্সপা সি, ফাস্ট এক্সআর, টামেন, রেনোভা, রেনোভা এক্সআর এগুলো সবই প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ। কিন্তু ক্রেতাদের এগুলো দিলে নিতে চায় না। উল্লিখিত সব ওষুধ বাজারে স্বাভাবিক থাকলেও মানুষ শুধু শুধু নাপার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে কারনে শুধুমাত্র ওই ওষুধটির সংকট দেখা দিয়েছে।
মেসার্স শুকতারা ফার্মেসীর মো: সাইফুল ইসলাম লালন বলেন, নাপার এতোই সংকট যে, ১০ বক্সের অর্ডার দিলে কোম্পানী থেকে এক বক্স দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে মোটেও দেয়া হয় না। মানুষের মধ্যে ‘নাপা লাগবে’ এটি একটি বড় রোগে পরিণত হয়েছে। নাপার বাইরেও এইস, এইস প্লাস, রিসেট, রিসেট প্লাসসহ অজ¯্র প্যারাসিটামল বাজারে আছে। কিন্তু মানুষ তা কিনতে চায় না।
মূলত: কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দামে বিক্রির স্বপ্ন দেখছেন এমন অভিযোগও করেন কেউ কেউ। কিন্তু এটিকে নাকচ করে দিয়ে হেরাজ মার্কেটের জয়া মেডিকেল হলের প্রোপ্রাইটর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ সাদী বলেন, নাপা এমন কোন ওষুধ না যে, মজুদ রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে হবে। এটি মানুষের একটি ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে কোম্পানীই চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছে না। মানুষ যখন বুঝবে যে, নাপা মানে নাপা না, ওটি প্যারাসিটামল গ্রুপের একটি ওষুধ তখনই সংকট কাটবে। অন্যথায় এ সংকট থেকেই যাবে।
বাংলাদেশ কেমিস্টস্ এন্ড ড্রাগিষ্টস্ সমিতি খুলনা শাখার সভাপতি আলহাজ¦ মোজাম্মেল হক বলেন, প্যারাসিটামল মজুদ করে রাখলে কোন লাভ নেই। কারণ দু’দিন পরতো এর চাহিদা থাকবে না। আসলে প্যারাসিটামল বলতে মানুষ নাপাকেই বোঝে। এটিই সংকটের কারণ। কিন্তু ক্রেতারা যদি প্যারাসিটামল গ্রুপকে মনে রাখে তাহলে আর শুধু নাপার পেছনে দৌড়ে বেড়াবে না। মানুষের এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।