নিজের সঠিক বয়স বলতে পারেন না। এতটুকু কেবল মনে আছে যুদ্ধের সময় তার বড় ছেলে হাঁটতে পারে। এরপরের গল্প দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই সংগ্রামের। সাত সন্তানের মা সজিমন বেগমের নিজের বলতে কোনো ঠিকানা ছিল না। বিয়ের পর থেকে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে অল্প টাকার ভাড়ার ঝুপড়ি ঘরেই কেটেছে জীবন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী সরকারের আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ঘর পেয়েছেন তিনি। জীবনের শেষ বেলায় এসে নিজের ঘর পেয়ে তাই খুব খুশি।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া গ্রামের আশ্রয়ন প্রকল্পের নিজের ঘরের সামনে কথা হয় সজিমন বেগমের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করতেই হাসিমুখে জবাব, ‘বয়স হইছে, কাজকাম করতে পারি না। এখন নিজের একটা ঠিকানা পাইলাম। কত যে খুশি হইছি বলে বোঝাতে পারব না।’

স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে উঠবেন বিল্লাল হোসেন। বড় মেয়ে আফসানা পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। মেজো ও ছোট মেয়ে আফরোজা এবং মিম প্রাইমারিতে। পাঁচজনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বিল্লালের আয়ের বড় একটা টাকা খরচ হয়ে যেত বাসা ভড়ায়। মেয়েরা বড় হচ্ছে সঞ্চয়ের চিন্তা চাইলেও করতে পারছিলেন না। এবার সেই পথ সহজ হলো। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন তিনিও।

সামনে দাঁড়াতেই চোখ মুখ উজ্জল করে নিজেই বলতে শুরু করলেন, এখন তো আর ঘর ভাড়া দিতে হবে না। মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করতে পারব এখন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্লাল হোসেনের স্ত্রী বার বার প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করছিলেন। আর বলছিলেন, এটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। নিজের বাড়ি হবে, ঘর হবে। তাও আবার পাকা। এটা তো কখনই ভাবি নাই। আল্লাহ ওনাকে (প্রধানমন্ত্রী) অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখুন।

রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে মুড়াপাড়া গ্রামে পাইলট প্রকল্পে ২০টি পরিবারকে ঘর দেয়া হয়েছে। তাদের সবার জীবনের গল্পই মোটামুটি একই রকম। ভূমি ও গৃহহীন এসব পরিবার পেয়েছে নিজেদের ঠিকানা। প্রতিটি পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত দুই রুমের ঘরে জ্বলছে বিদ্যুতের আলোও। আলোকিত তাদের চোখ মুখও।

শুধু রূপগঞ্জই নয়; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী সরকারের আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হচ্ছে।

বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য নির্মাণ করা ঘর পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২৩ জানুয়ারি সারা বিশ্বে প্রথমবারের মতো কোনো দেশে একসঙ্গে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমির মালিকানা দিয়ে বিনা পয়সায় দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘর মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী প্রদান করবেন। এছাড়াও ২১টি জেলার ৩৬টি উপজেলায় ৪৪টি প্রকল্প গ্রামে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণের মাধ্যমে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হবে বলেও জানান তিনি।

আশ্রয়ন প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ন নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যা প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৩ লাখ ২০ হাজার ৫২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

আশ্রয়ন প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্ন অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, ঋণপ্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ।

ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে মুজিববর্ষে ‘বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের বাসস্থান নিশ্চিতকল্পে ‘মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২০ সালের জুনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা করা হয়েছে।