মুহাম্মদনগর প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলনা
জেলার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত

এ এইচ হিমালয় : শিক্ষক মিলনায়তনের পাশে সাজানো-গোছানো একটি কক্ষ। দেয়ালের একপাশ জুড়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ছবি। অন্য দুই পাশ জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই। চেয়ার-টেবিলে বসে ছোটদের জন্য লেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়ছিলেন কিছু শিক্ষার্থী।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর সীমান্তবর্তী মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনে ঢুকতেই এ দৃশ্য দেখে চোখ আটকে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, কিছু শিক্ষার্থী বই পড়ছে, দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধ সময়কার ছবি দেখছে ৬-৭ জন।
এখানে কি হচ্ছে জানতে চাইলে চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী জান্নাতুন মাওয়া জানালো, ক্লাস কিছুক্ষণ পরে শুরু হবে। হাতে সময় থাকায় সবাই তারা এখানে বসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়ছে, কেউ কেউ ছবি দেখছে। মাঝে মাঝে টিভি চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভিডিও দেখা যায়। এই কক্ষের নাম ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’।
চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র জুবায়ের মাহমুদ বললো, কক্ষটি সব সময় খোলা থাকে। আমরা সময় পেলেই চলে আসি। বই পড়ি, ছবি দেখি। আমাদের ভালো লাগে।
কক্ষের নাম না বললেও ভেতরের পরিবেশ এবং সাজানোর ধরন দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই বিশেষ কিছুর আয়োজন করা হয়েছে এখানে। কক্ষটির ভেতরে ঢুকে দেখা গেলে, আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কক্ষটি। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ছাড়াও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের অসংখ্য আলোকচিত্র। দেয়ালের একপাশে দেখা গেল একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা চিঠি। মফস্বলের একটি স্কুলের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন আয়োজন সত্যি অবাক করার মতো।
প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ থেকে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ী সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার খোলা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আয়োজন হয়েছে দায়সারা। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা গেল মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান ময়না জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ডিসেম্বর মাস থেকে আমরা কাজ শুরু করি। কাজ শুরুর আগে বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ সবাই পালন করলেও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ দুটোই আমাদের আবেগের বিষয়। ছোট্ট সোনামনির মাঝে এই বিষয়ে আগ্রহ জাগাতে না পারলে তারা সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে। এজন্য স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ অন্যদের নিয়ে পরিকল্পনা করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারটি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো, শিশুরা যেন নিজেরাই এখানে আসতে আগ্রহী হয়। কাজ শেষে মনে হচ্ছে আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়েছে।
তিনি জানান, গত ১৬ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আকরাম আল হোসেন কর্নারটি উদ্বোধন করেছেন। এরপর থেকে ক্লাস শুরুর আগে এবং শেষে, ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীরা কর্নারটি ঘুরে দেখেন। এখানে কোনো শিক্ষক থাকে না। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো বই পড়ে, ছবি দেখে। নিজেরাই সব গুছিয়ে রাখে।
মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, স্কুলের সাজসজ্জায়ও যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। একাডেমিক ভবনের প্রতিটি কক্ষ শিশুদের মতো করে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি কক্ষে রয়েছে গ্রাম বাংলা এবং পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন ছবি। বারান্দায় রয়েছে বিভিন্ন সাজসজ্জা, পাখির বাসা। গত ২৯ নভেম্বর এ নিয়ে দৈনিক পূর্বাঞ্চলে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ হয়েছিলো। এরপর থেকে দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা স্কুলটি দেখতে আসছেন।
॥ জেলার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৌরব অর্জন ॥
এদিকে শুধু সাজসজ্জাই নয়; সব দিক থেকেই এবার বটিয়াঘাটা উপজেলা এবং খুলনা জেলার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৌরব অর্জন করেছে মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান ময়না বটিয়াঘাটা উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। বিভাগীয় পর্যায়েও চূড়ান্ত লড়াইয়ে মাত্র দুই নম্বর কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে মুহাম্মদনগর স্কুল।
এদিকে গত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ভালো ফলাফল ধরে দেখেছে বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। এবার ১৩৩ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ বৃত্তি পাবে বলে আশা করছে শিক্ষার্থীরা।
॥ খেলার মাঠ চায় শিশুরা ॥
বিভাগীয় পর্যায়ের সেরা স্কুল হওয়ার দৌড়ে খেলাধুলা বিভাগে দুই পয়েন্ট কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই ফলাফল স্কুলের শিক্ষার্থীদের মন আরও খারাপ করেছে। কারণ খেলাধুলার কোনো সুযোগই নেই বিদ্যালয়টিতে। নেই কোন খেলার মাঠ, নেই একটু বিনোদনের জায়গা। যার কারণে গত ১৬ জানুয়ারি শিক্ষা সচিবকে কাছে পেয়ে শিশুরা খেলার মাঠের আবদার করে বসে। সচিবও বিদ্যালয়ের পাশের ব্যক্তি মালিকানা জমি দ্রুত অধিগ্রহণ করে শিশুদের জন্য মাঠ তৈরির জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। এর প্রায় একমাস অতিবাহিত হলেও এ ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোঃ হেলাল হোসেন বলেন, বিদ্যালয়টি ঘুরে সবারই ভালো লেগেছে। জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
॥ প্রয়োজন আরও শিক্ষক ও শ্রেণীকক্ষ, নেই বাথরুম॥
শিক্ষার পরিবেশ ভালো হওয়ায় এ বছর বিদ্যালয়টিতে ১ হাজার ১১৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। বিদ্যালয়ে ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক প্রয়োজন ২৭ জন। অনেক লেখালেখির পর বিদ্যালয় ১৫ জন শিক্ষক পদায়ন করা হয়। এতে পরীক্ষার ফলাফল কিছুটা ভালো হয়েছে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। এখানে জরুরী ভিত্তিতে আরও কয়েকজন শিক্ষক প্রয়োজন। বিদ্যালয়ে একাডেমিক ভবন রয়েছে একটি। সেখানে শ্রেণীকক্ষ রয়েয়ে মাত্র ৯টি। প্রয়োজন আরও ১৫টি কক্ষের। এজন্য ভবন প্রয়োজন। কিন্তু জায়গার অভাবে ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না।
সবচেয়ে দুর্ভোগের বিষয় প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর জন্য সরকারিভাবে কোনো টয়লেট বরাদ্দ নেই। গ্রামের জন্য এখন ওয়াশব্লক নির্মাণ করা হলেও এই স্কুল বরাবরই এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর সরকারি টয়লেট সুবিধা নিশ্চিত করা অতি জরুরী।
বিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি শেখ হাফিজুর রহমান হাফিজ বলেন, বটিয়াঘাটার এই এলাকায় নি¤œবিত্ত, নি¤œ-মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস। এই এলাকায় কোনো ভালো স্কুল নেই। বাবা-মা যতো গরীব হোক না কেন-সবাই চায় তার সন্তানকে ভালো পরিবেশে পড়ানোর। সেই চিন্তা থেকে আমাদের স্কুলের পরিবেশকে কিভাবে শহরের স্কুলগুলোর চাইতে উন্নত করা যায়-সেজন্য পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছি। আমরা শ্রেণিকক্ষগুলো¬ বাচ্চাদের মনের মতো করে সাজিয়েছি। যার কারণে স্কুলের শিক্ষার্থী উপস্থিতি ৮০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে।
প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান ময়না বলেন, স্কুলের পরিবেশ সুন্দর করতে সবাইকে পোশাক দেওয়া হয়েছে। যাদের টাকা নেই তারা বিনামূল্যে পোশাক পায়। বাচ্চারা এখন ছুটির দিনেও স্কুলে আসতে চায়। খেলার মাঠ এবং আরও কয়েকজন শিক্ষক হলে পরীক্ষার ফলাফল আরও ভালো হবে। একদিন নগরীর নামকরা স্কুলকে পেছনে ফেলে দেবে মুহাম্মদনগর স্কুল।