এস. এম মোস্তাফিজুর রহমান, ফুলতলা (খুলনা): দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক সংকট, ওষুধ ঘাটতি, যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা ও অব্যবস্থাপনায় ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যত অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী অভয়নগর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ চিকিৎসা সেবার জন্য এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর নির্ভরশীল। অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বাস্তব চিত্র যেন এক চরম অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে চিকিৎসক পদের সংখ্যা ২৫টি হলেও নিয়মিত সেবা দিচ্ছেন মাত্র গুটিকয়েক চিকিৎসক। ১০টি কনসালটেন্ট পদের মধ্যে মাত্র ৩ জন কর্মরত। এর মধ্যে গাইনী ও মেডিসিন কনসালটেন্ট খুলনায় অবস্থান করেন সপ্তাহের চার দিন এবং মাত্র দুই দিন ফুলতলায় আসেন। একমাত্র শিশু কনসালটেন্ট নিয়মিত হাসপাতালে অবস্থান করেন। এদিকে ১৪টি মেডিকেল অফিসার পদের মধ্যে মাত্র ৪ জন চিকিৎসক নিয়মিত সেবা দিয়ে চলেছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ডা. ইমরান ও ডা. সত্যজিৎ নামে দুই কনসালটেন্ট এবং ডা. ফারহানা রহমান এ্যানি ও ডা. জেবুন্নেসা জেবু নামে দুই মেডিকেল অফিসার ডেপুটেশনে খুলনায় কর্মরত। অথচ তাদের বেতন-ভাতা উত্তোলন হচ্ছে ফুলতলা থেকে। এতে করে ফুলতলায় চিকিৎসক সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মী ও সহায়ক কর্মচারীর সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। তৃতীয় শ্রেণির ৬৭টি পদের বিপরীতে কর্মরত ৪৭ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ২৩টি পদের বিপরীতে মাত্র ৮ জন কর্মরত আছেন। এর ফলে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে কাজের সঠিক তদারকি এবং পরিচালনায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গত অর্থবছরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১৯ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের বেতন পরিশোধ না হওয়ায় তারা এ বছর কাজে যোগ দেননি। একইভাবে হাসপাতালের রন্ধনশালায় কোন বাবুর্চি নেই, ফলে রোগীদের খাবার ব্যবস্থা নিয়েও দেখা দিয়েছে জটিলতা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে পুরো হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী। ফলে হাসপাতাল জুড়ে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে। রোগীদের ও স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের শৌচাগার, বাথরুম, করিডোর ও ওয়ার্ডে দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে উঠছে।
ফুলতলা উপজেলার ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিকের কোনটিতেই কোনো ওষুধ সরবরাহ নেই। এমনকি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এনসিপি কর্ণার এবং বহির্বিভাগেও ওষুধ সংকট বিরাজমান। চক্ষু রোগের চিকিৎসায় নেই কোনো চিকিৎসক বা যন্ত্রপাতি। এখনও ব্যবহার হচ্ছে সনাতন আমলের একটি এনালগ এক্স-রে মেশিন। আধুনিক কোনো আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি বা ডিজিটাল রেডিওলজির ব্যবস্থা নেই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো হাসপাতালে সাপের কামড়ের জন্য অ্যান্টিভেনম এবং কুকুরে কামড়ানোর ভ্যাকসিন মজুদ নেই। ফলে বিষাক্ত সাপের কামড় কিংবা জলাতঙ্ক ঝুঁকির রোগীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জেসমিন আরা বলেন, “জনবল সংকটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার জানিয়েছি। বিশেষ করে কনসালটেন্ট ও মেডিকেল অফিসার পদে লোকবল না থাকায় সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আউটসোর্সিং কর্মচারীদের বেতন সংক্রান্ত জটিলতা এখনও নিরসন হয়নি। আশা করছি দ্রæত সমাধান হবে।”
উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাসনীম জাহান বলেন, “বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।”এমন বেহাল অবস্থার কারণে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার সাধারণ মানুষ। সামান্য জ্বর, ব্যথা বা গাইনী সমস্যার জন্যও রোগীদের খুলনা শহরের বেসরকারি হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছে। এতে চিকিৎসা ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য। দ্রæত প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, ওষুধ সরবরাহ, যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ ও চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন এলাকাবাসী।