সম্পাদকীয়
একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ হলো বন্দর। বাংলাদেশে তিন তিনটি সমুদ্র বন্দর। এছাড়াও একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণাধিন রয়েছে। এটি বাংলাদেশের মত একটি ছোট দেশের জন্য আশির্বাদ। কারণ পৃথিবীতে অনেক দেশই রয়েছে যে দেশে একটিও সমুদ্রবন্দর নেই। আমাদের আশপাশেও এমনি ‘ল্যান্ডলক্ট কান্টি’ রয়েছে যে দেশের আমদানী-রফতানী ব্যবস্থা পরিচালনা করতে অন্যে দেশের বন্দর উপর নির্ভর করতে হয়ে। সে দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশ অনেক ভাগ্যবান যে ৩টি সমুদ্র বন্দরের মালিক । ভৌগলিক কারণেই বাংলাদেশ এমনি তিনটি সমুদ্র বন্দরের মালিক হতে পেরেছে। চট্টগ্রাম আমাদের দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। দেশের আমদানী-রফতানীর সিংহভাগই সম্পন্ন হয় এ বন্দরের মাধ্যমে। এ বন্দরের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত কার্যক্রমও মাঝে মাঝে সম্পন্ন করতে হয়। এ জন্য আমদানী-রফতানী বাণিজ্যে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হন। এমনি অবস্থায় মোংলা বন্দরও এখন অনেক বেশী ব্যস্ত বন্দরে পরিণত হয়েছে। বন্দরগুলির এ ব্যস্ততা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য খুবই ইতিবাচক। চট্টগ্রাম-মোংলা ছাড়াও আমাদের নবাগত পায়রা সমুদ্র বন্দর খুব সম্ভাবনাময়। এ বন্দরও মোংলা বন্দরের মতই কালে কালে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ তিনটি সমুদ্র বন্দরকে ঠিকঠাক মত কাজে লাগাতে পারলে আমাদের বন্দরভিত্তিক ব্যবসা- বাণিজ্য ক্রমেই সমৃদ্ধ হবে এটি নিশ্চিত। কিন্তু এক্ষেত্রে বন্দরের যত অব্যবস্থাপনা রয়েছে সব দূর করতে হবে। বন্দর ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে সেবার মান বাড়াতে হবে। অযথা যাতে বন্দর ব্যবহারকারীরা হয়রানির স্বীকার না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। বন্দরে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস চালু করতে হবে। একটি বন্দর নানামুখি ব্যবসার উৎসস্থল। আমাদানী-রফতানী বাদেও প্রতিটি বন্দরের পশ্চাৎভূমি ব্যাকওয়াড লিংকেজ শিল্পের জন্য সম্ভাবনাময় স্থানে পরিণত হয়। যেমন চট্ট্রগ্রাম, মোংলা এবং পায়রা বন্দরের আশপাশের জেলাসমূহে বন্দরনির্ভর নানা ধরণের ব্যবসা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে দৃষ্টিকোণে ভৌগলিক সুবিধার বদৌলতে আমাদের যে বন্দরগুলি রয়েছে সেগুলিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ বন্দরসমূহের উন্নয়নে যে প্রকল্প সহায়তাগুলি দেয়া হয় সেগুলিরও সদ্ব্যবহার করতে হবে। এখানে সম্পদ ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত বন্দর প্রশাসন বিদায় করে ব্যবসাবান্ধব বন্দর ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে। আমরা সকল ক্ষেত্রেই চাই দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা হিসেবে স্বীকৃত বন্দরগুলি ব্যবস্থাপনা যাতে উন্নত হয়। বহির্বিশ্বে বন্দরগুলির ইমেজ যাতে বাড়ে। বন্দর ব্যবহারহারী দেশী-বিদেশী আমদানী-রফতানীকারকরা যাতে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী হয়ে বাংলাদেশের বন্দরগুলি বেশী বেশী ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। দেশের অর্থনীতির জন্য পায়রা একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। বন্দরের কাজ যেন আরও ত্বরান্বিত হয় এবং প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা যেন শতভাগ সদ্ব্যবহার করা হয়, তা’ নিশ্চিত করা হবে। তবে বিশ্বের কোনো বন্দর রাতারাতি প্রতিষ্ঠা হয়নি, সে জন্য সময় দিতে হবে। বন্দরটিকে লাভজনক করতে হলে যোগাযোগব্যবস্থার (কানেক্টিভিটি) উন্নয়ন করতে হবে। বিশেষ করে চার লেনের রাস্তা ও রেললাইনের কাজ দ্রæত শুরু করতে হবে। এ ছাড়া দেশের আমদানি পণ্যের কিছু অংশ এই বন্দর ব্যবহার করে আনার ব্যবস্থা করতে পারলে এ বন্দর সচল হবে; পাশাপাশি বন্দরের আয়ও বাড়বে আর অন্য বন্দরগুলোর ওপর থেকেও চাপ কমবে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, পায়রা বন্দর প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বন্দরে ২ হাজার ৮০২টি দেশি-বিদেশি জাহাজ ভিড়েছে। এতে বন্দরের ১ হাজার ৫০৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আয় হয়েছে। পায়রা বন্দরটি খুবই নতুন। এ বন্দরের ভৌত অবকাঠামোগত অনেক কাজই এখনো বাকী রয়েছে। আমরা মনে করি পায়রা বন্দরটিও চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমাদের চট্টগ্রাম, মোংলা এবং পায়রা বন্দর যখন একে অপররের পরিপূরক বন্দর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে তখন নিঃসন্দেহে তা’ আমাদের অর্থনীতির জন্য বিরাট এক অর্জন হিসেবেই বিবেচিত হবে। এ জন্য আমরা পায়রা নবাগত বন্দর হিসেবে এ বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্টদের বন্দর উন্নয়নে বেশী বেশী মনোযোগী হওয়ার পাশাপশি সরকারের বরাদ্দসহ অন্যান্য সহায়তা যেন কার্যকর অর্থেই বন্দরের উপকারে লাগে সে বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি। একই সাথে অপরাপর বন্দরগুলিকে বৈশ্বিক চাহিদার সমান্তরালে নিরন্তর উন্নয়নের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। কারণ বাংলাদেশের বন্দরগুলিকে উন্নত ব্যবস্থাপনায় বৈশ্বিক মানদন্ডে উন্নত করতে পারলে তা আমাদের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে করি।