চানরাতের আয় ২শ’ টাকা
বাবা মায়ের ওষুধেই খরচ

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ মোঃ সুজন হোসেন। ছিলেন খালিশপুরের ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক। গত বছর পয়লা জুলাই থেকে তিনি বেকার। উপায় না পেয়ে দৌলতপুর কাঁচা বাজার থেকে পাইকারি মাল কিনে সেখানেই খুচরা বিক্রি করেন। ঘরের বৃদ্ধ পিতা-মাতা নিয়ে তিনি চলছেন এভাবেই। ঈদের আগের রাতে এমনি করে আয় হয় ২শ’ টাকা। যা দিয়ে অসুস্থ পিতা-মাতার জন্য ওষুধ কেনেন। ফলে ঈদের দিন বৃদ্ধ পিতা-মাতার মুখে সেমাই পর্যন্ত দিতে পারেননি সুজন। বিয়ে করেছেন কি না জানতে চাইলে সুজন বললেন দেখাদেখি চলছিল, কিন্তু মেয়ে পক্ষ যখনই শোনে ছেলে জুট মিলের বদলী শ্রমিক, তখনই বিয়ে ভেঙে যায়। এ অবস্থা অবশ্য মিল বন্ধের আগের। আর এখনতো মিল বন্ধ। সুতরাং বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে কে ? এমন পাল্টা প্রশ্ন সুজনের।
গত বছর(২০২০) জুলাই মাসে দেশের ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের ফলে সারাদেশের ন্যায় খুলনাঞ্চলের পাটকল শ্রমিকরাও বেকার হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে স্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ শুরু হলেও বদলি ও দৈনিক মজুরী ভিত্তিক শ্রমিকদের পাওনার বিষয়টি ঝুলে আছে। তাদের পাওনা দেয়ার ব্যাপারে বিজেএমসি সম্মতি হয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মমন্ত্রনালয়ের অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। লকডাউনের কারণে এখনও সেটি সিদ্ধান্তহীন। এজন্য মিলগুলো থেকে একটি হিসাব বিজেএমসিতে দাখিল হয়েছে। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে মজুরী কমিশন ঘোষণা হওয়ায় সেই থেকে মিল বন্ধের আগ পর্যন্ত তাদের বর্ধিত হারের মজুরী যেমন পাওনা রয়েছে তেমনি ২০১৯ সালের ছয় সপ্তাহের পাওনা বাবদ ২৫ মিলের বদলী শ্রমিকদের বকেয়ার পরিমাণ প্রায় পৌনে ৪শ’ কোটি টাকা বলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। তবে বদলী শ্রমিকদের ঠিক পাওনার পরিমাণ কত তা’ জানাতে নারাজ মিল কর্তৃপক্ষ। যদিও মিলের হিসাব বিভাগ থেকে শ্রমিকরা যার যার পাওনার বিষয়টি জেনেছেন উল্লেখ করে প্লাটিনাম জুট মিলের মো: মনোয়ার হোসেন বলেন, তার পাওনা এক লাখ ৭২ হাজার টাকা। এমনিভাবে প্লাটিনামের ডালিয়ার দু’লাখ ২৫ হাজার, মো: বুলুর এক লাখ ৭৫ হাজার, স্টারের হামজা গাজীর তিন লাখ ৪৫ হাজার, জেজেআই’র শ্যামল মল্লিকের ৯১ হাজার টাকা পাওনা আছে বলে তারা স্ব স্ব মিলের হিসাব বিভাগ থেকে জানতে পেরেছেন। এছাড়া দৈনিক মজুরী ভিত্তিক শ্রমিক থাকায় খালিশপুর(পিপলস) ও দৌলতপুর জুট মিলের শ্রমিকদেরও মিল বন্ধের পর কোন অর্থ দেয়া হয়নি।
পাওনা বঞ্চিত এসব বেকার বদলী শ্রমিকদের এবারের ঈদ কেমন কাটল জানতে চাইলে প্লাটিনামের মো: মনোয়ার হোসেন বলেন, চাকরীহারা হওয়ার পর থেকেই তিনি ইজিবাইক চালান। এমনকি ঈদের দিনও ইজিবাইক চালিয়েছেন। বৃদ্ধ পিতা-মাতা বার্ধক্যজনিত রোগী। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সাত সদস্যের পরিবারে ঈদের দিন সেমাই পর্যন্ত রান্না হয়নি। আর নতুন কাপড়েরতো প্রশ্নই ওঠে না।
এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, জুট মিলে কাজ করতে গিয়ে তার ডান হাতের চারটি আঙ্গুল মেশিনে কেটে যায়। কাটা আঙ্গুল দিয়েই তিনি ২০১২ সাল থেকে মিলে শ্রম দিয়ে আসছেন। কিন্তু মিল বন্ধের পর খালি হাতেই বিদায় নিতে হয়। তবে এখনও তিনি আশা করছেন যে, হয়তো পাওনা পাবেন।
১০ বছর ধরে প্লাটিনামের ফিনিশিং বিভাগে কাজ করেন ডালিয়া। ছেলে রবিউলও ছিলেন তার মতো বদলী শ্রমিক। চাকরীহারা হবার পর প্লাটিনামের ২ নম্বর গেটে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে চা দোকান দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও বেচা বিক্রি নেই। এজন্য ঘর ভাড়াও বাকী পড়েছে। ডালিয়ার স্বামীও ছিলেন একই মিলের বদলী শ্রমিক। মিল বন্ধের অনেক আগেই তিনি অক্ষম। স্বামী, ছেলে, মেয়ে, নাতি-নাতনী নিয়ে সর্বমোট ১২ সদস্যের পরিবার ডালিয়ার। প্লাটিনামের পাশের ভরা পুকুর বস্তিতে তাদের বাস। নিজে, ছেলে ও জামাইদের মধ্যে যারা উপার্জনক্ষম ছিলেন তারা সবাই এখন বেকার। এজন্য বাসা ভাড়াও বাকী পড়েছে কয়েক মাসের। ঈদের আনন্দ বলতে যা বোঝায় তা ছিল না তাদের পরিবারেও।
ঈদের আগের দিন পরিচিত একজনের দেয়া সেমাই চিনিতে ঈদ হয়েছে ক্রিসেন্ট জুট মিলের আর এক বদলী শ্রমিক মো: আনোয়ার হোসেনের। দু’সন্তান আর মা’সহ তাদের পরিবার। আয় করেন তিনি একা। বিগত নয় মাস ধরে রয়েছেন বেকার। পিতাও মিলে চাকরী করতেন। মারা গেছেন আগেই। সরকারি সাহায্যের মধ্যে তিনি একবার সাত কেজি চাল ও একশ’ টাকা পেয়েছেন।
মিলের কাছে পাওনা টাকা পেলে ব্যবসা করার চিন্তা করছেন স্টার জুট মিলের শ্রমিক হামজা গাজী। তিনি ছিলেন মেকানিক্যাল বিভাগের বদলী শ্রমিক। তার পাওনা আছে পৌনে চার লাখ টাকা। ছেলে-মেয়েকে নতুন জামা কাপড়তো দূরের কথা তার সংসারেও ঈদের দিন সেমাই রান্না হয়নি বলে জানান।
প্লাটিনামের পিপিয়ারিং বিভাগের বদলী শ্রমিক ছিলেন মো: বুলু। মিল বন্ধের পর দৈনিক ভিত্তিক মজুরীতে কাজ করার পাশাপাশি রংয়ের কাজও করেন। কিন্তু দেশের উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে কাজও নেই। বাসা ভাড়া দুই মাসের বকেয়া পড়েছে তার। মিলের কাছে তার পাওনা আছে পৌনে দু’লাখ টাকা।
একই মিলের বদলী শ্রমিক ছিলেন আব্দুল মান্নান। বিগত তিন বছর ধরে তিনি অসুস্থ্য। প্যারালাইসিসে ভুগছেন। বড় ছেলেও প্লাটিনামের তাঁত বিভাগের বদলী শ্রমিক ছিলেন। ছোট ছেলেটা একটি মুদি দোকানে কাজ করেন। ছেলেরা ধরে এনে প্লাটিনামের ২ নম্বর গেটে বসিয়ে দিয়ে যান আর তিনি সেখানে বসে সারাদিন বাদাম বিক্রি করেন। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বিকাশে ২৫’শ টাকা পেয়েছেন তিনি। এছাড়া শ্রম অধিদপ্তরের দেয়া ৪/৫ কেজি চাল ও অর্ধেক মুরগী দেয়া হয়েছিল একবার। এর বাইরে আর কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। তার সংসারেও এবার ঈদে কোন নতুন কাপড় কেনা হয়নি।
নওয়াপাড়ার রাজঘাটের জেজেআই’র বদলী শ্রমিক শ্যামল মল্লিক এখন স্থানীয় আকিজ সিটির চাইনিজ রেস্তোরাঁয় বয়-এর কাজ করেন। তার মতো আরও ৮/১০জনে করেন একই কাজ। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে কয়লা ঘাটে লেবারের কাজ করেন আবার কেউ শীল পাটার কারখানায় কাজ করেন বলেও জানান।
বদলী শ্রমিকদের সংগঠন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের বদলী/দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ খুলনা-যশোর আঞ্চলিক কমিটির আহবায়ক মো: ইলিয়াস হোসেন বলেন, সারাদেশের ২৫টি পাটকলের বদলী শ্রমিকদের প্রায় পৌনে চারশ’ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। যা পরিশোধ না করায় কর্মহীন শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। সর্বশেষ তাদের পক্ষ থেকে ঈদের আগে বকেয়া পরিশোধ না হলেও অন্তত কিছু ত্রাণ সহায়তা দেয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। এজন্য সরকারের সহায়তা প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থার নিকট আবেদনও জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোন সহায়তা তাদেরকে দেয়া হয়নি।
বদলী শ্রমিকদের সাবেক নেতা এবং বন্ধ হওয়া মিলের স্থায়ী শ্রমিক মো: নূর ইসলাম বলেন, শিল্পাঞ্চলে বর্তমানে হতদরিদ্র বা অভাবী লোকদের তালিকা করলে আগেই আসবে পাটকলের বদলী শ্রমিকদের নাম। কিন্তু তাদের কথা কেউ মনে করছে না। এটি অনেকটা অমানবিক বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিভাগীয় শ্রম পরিচালক মো: মিজানুর রহমান বলেন, পাটকল বন্ধের পর স্থায়ী শ্রমিকদের মধ্যে যারা অবসরে গেছেন এবং অবসান দেয়া হয়েছে তাদের পাওনা পরিশোধ কার্যক্রম চলছে। বদলী শ্রমিকদের বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদনের পরই পাওনা দেয়া শুরু হবে।