৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি এ বছর নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় ২৪ জুন অনুষ্ঠিত বাছাইপর্বের নির্বাচনে তিনি নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোসহ প্রায় এক ডজন প্রার্থীকে পরাজিত করে রীতিমতো ইতিহাস গড়েছেন। সরকারিভাবে ফলাফল পেতে আরও দিন দুয়েক লাগবে, তবে তাঁর বিজয় নিয়ে কোনো পক্ষেরই সন্দেহ নেই।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মামদানি একজন মুসলিম। নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন এ শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র। মাত্র ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণকারী মামদানি রাজনীতিতে একেবারেই নবাগত। এর আগে মাত্র চার বছর তিনি নিউইয়র্কের একটি স্থানীয় সিটি কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দুই দফায় দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমো পরপর তিন দফায় এ রাজ্যের গভর্নর নির্বাচিত হন। বিভিন্ন অনিয়ম ও তাঁর অধীনস্থ একাধিক নারীকে যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগে ২০২১ সালে পদত্যাগের আগে কুমোকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মেয়র পদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি মার্কিন রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলেন। মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত কুমো এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নিজে প্রায় ৮ মিলিয়ন ডলার ও তাঁকে সমর্থনকারী একটি রাজনৈতিক কমিটি আরও ২৪ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করে।এমন একজন শক্ত প্রার্থীকে মামদানি কীভাবে পরাজিত করলেন? স্রেফ স্বপ্ন বিক্রি করে। মামদানি একজন সোশ্যালিস্ট, ডেমোক্রেটিক পার্টির সবচেয়ে বামঘেঁষা অংশের সদস্য। নির্বাচনে তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল—এই শহরকে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য অধিক বসবাসযোগ্য করে তুলবেন। এ লক্ষ্যে তিনি সরকারি ব্যবস্থাপনায় কম মূল্যের মুদিদোকান খোলার প্রস্তাব করেছেন। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য নতুন দুই লাখ অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ ও ভাড়ানিয়ন্ত্রিত অ্যাপার্টমেন্টে আগামী চার বছর ভাড়া বাড়ানো নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সব নিউইয়র্কবাসীর জন্য নিখরচায় শিশু পরিচর্যার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। প্রস্তাব করেছেন বিনা ভাড়ার সরকারি বাসের। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে শহরের ধনী ব্যক্তি ও করপোরেশনের ওপর অতিরিক্ত আয়কর আরোপের মাধ্যমে আট বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
অন্য যে কারণে মামদানি নিউইয়র্কের তরুণ ও নতুন প্রজন্মের ভোটারদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন, তা হলো গাজা প্রশ্নে ইসরায়েলের প্রতি তাঁর কঠোর সমালোচনাপূর্ণ অবস্থান। প্রায় ৪০ হাজার স্বেছাসেবকের এক বাহিনী তাঁর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেয়, যাঁদের অধিকাংশই ছাত্র অথবা নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি। গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলের হামলাকে মামদানি খোলামেলাভাবেই ‘গণহত্যা’ বলে সাব্যস্ত করেছেন। তাঁর এই অবস্থানকে শহরের ইহুদি লবি ও প্রথাগত রাজনীতিকেরা ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কুমো নিজেও তাঁকে মার্কিন মূলধারার বাইরের একজন বাস্তবতাবিবর্জিত রাজনীতিক হিসেবে বাতিল করে দেন। মামদানি একসময় পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার কমাতে তাদের বাজেট বরাদ্দ হ্রাস করার প্রস্তাব করেছিলেন। সেটিও কুমোর সমালোচনার শিকার হয়।
মামদানির অভাবিত বিজয়, যাকে এককথায় একটি ‘রাজনৈতিক ভূমিকম্প’ বলা যায়। এটি ২০০৮ সালে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনকে মনে করিয়ে দিয়েছে। দেশের প্রথাগত রাজনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে প্রধানত অশ্বেতাঙ্গ, বহিরাগত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের সমর্থনে দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ওবামা।মামদানি শুধু অশ্বেতাঙ্গ নন, তিনি একজন মুসলিম। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পর থেকে এ দেশে মুসলিমবিদ্বেষ বহুগুণ বেড়েছে; বেড়েছে অশ্বেতাঙ্গ বহিরাগত মানুষদের জোরপূর্বক বিতাড়ন। মামদানি, যিনি ট্রাম্পকে একজন ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সম্ভাব্য সব উপায়ে তাঁর বহিরাগতবিরোধী রাজনীতি ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি গাজায় অব্যাহত গণহত্যার জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলে তাঁকে গ্রেপ্তারের হুমকিও দিয়েছেন।
জোহরান মামদানির জন্ম উগান্ডার কাম্পালায়। সাত বছর বয়সে বাবা–মায়ের সঙ্গে নিউইয়র্কে আসেন তিনি। তাঁর মা ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মিরা নায়ার। বাবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামজাদা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি জন্মগতভাবে ভারতীয়।
মামদানির প্রার্থিতা নিউইয়র্কের বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দক্ষিণ এশীয় মানুষদের মধ্যে বিপুল আলোড়ন তোলে। সে কথা মাথায় রেখে মামদানি এবং এ শহরের একমাত্র নির্বাচিত বাঙালি কাউন্সিলর শাহানা হানিফ যৌথভাবে বাংলায় একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করেন। ২৪ জুন মধ্যরাতের পর তাঁর সমর্থকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের সময় মামদানি যেসব ‘বাংলাদেশি আন্টি’ তাঁর হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন, তাঁদের প্রতি ধন্যবাদ জানান।উল্লেখ্য, ২৪ জুন বাছাইপর্বের নির্বাচনে শাহানা হানিফও ডেমোক্রেটিক পার্টির কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন।
মামদানি এখনো মেয়র নির্বাচিত হননি, শুধু মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থিতা লাভ করেছেন। এই শহরের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার তালিকাভুক্ত ডেমোক্র্যাট, ফলে নভেম্বরে তাঁর বিজয় মোটেও অকল্পনীয় নয়। এ কথা ঠিক, মামদানির প্রার্থিতা ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান উভয় দলের প্রতিষ্ঠানপন্থী রাজনীতিকদের বিরোধিতার সম্মুখীন হবে। সবচেয়ে বড় বাধা আসবে দেশের ইহুদি লবি থেকে। কুমো নিজেও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ভাবছেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মামদানিকে যে একজন ‘অবাস্তব কমিউনিস্ট ও মার্ক্সিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রবল বিরোধিতা করবেন, তা প্রায় নিশ্চিত।
নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ট্রাম্পের উপদেষ্টারা ইতিমধ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে মামদানির মতো ‘বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন’ হিসেবে প্রমাণের জন্য অঙ্ক কষতে শুরু করেছেন।
মামদানি বিজয় ভাষণে বলেন, ‘আমরা রাতে স্বপ্ন দেখি, সকালে কাজে নেমে পড়ি।’ মামদানির সমর্থকেরা কাজে নেমে পড়েছেন, কিন্তু স্বপ্ন দেখা এখনো বন্ধ করেননি।