দেশে করোনা ভাইরাসের যে ভয়াবহ সংক্রমণ চলছে তা বোঝার কোনো উপায়ই নেই। গত তিন দিন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে পথে পথে ঢল নেমেছে লাখো মানুষের। ঈদের কেনাকাটা করতে দোকানপাট ও শপিংমলে দেখা যাচ্ছে উপচে পড়া ভিড়। রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে ইচ্ছেমতো। কেউ মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।

এদিকে, করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ইতিমধ্যে দেশে প্রবেশ করার পরও সর্বস্তরে স্বাস্থ্যবিধি না মানার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা আশঙ্কা করছেন, ঈদের পর দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে—যা হবে ভয়াবহ। ডাক্তার-নার্সের সংকটে ব্যাহত হবে চিকিত্সাসেবা। পরিস্থিতি ভারতের চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। দেখা দেবে অক্সিজেনের ভয়াবহ সংকট। চিকিত্সার অভাবে রোগীরা যেখানে সেখানে মারা যাবে

প্রসঙ্গত, বিশ্বখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন ডা. দেবী শেঠি মনে করেন, ভারতে কোভিড রোগীদের অক্সিজেন সংকট সমাধান হয়ে গেলে যে সমস্যাটি দেখা যাবে তা হলো—আইসিইউতে থাকা রোগীদের মৃত্যু। কারণ, তাদের চিকিত্সাসেবা দেওয়ার মতো যথেষ্ট নার্স-চিকিত্সক পাওয়া যাবে না। তখন চিকিত্সক ও নার্সের ঘাটতি মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সম্প্রতি ভারতের সিম্বিয়োসিস ইন্টারন্যাশনাল (ডিমড বিশ্ববিদ্যালয়) আয়োজিত স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এক ভার্চুয়াল সম্মেলনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। সেখানে এমন আশঙ্কার কথা জানান ডা. দেবী শেঠি।

এদিকে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে ঘরমুখী মানুষের প্রচণ্ড স্রোত। মানুষের ভিড়ে অ্যাম্বুলেন্স পারাপার হতে পারছে না। অক্সিজেনের অভাবে ইতিমধ্যে একজন শিশু সেখানে মারা গেছে। মানুষের বেপরোয়া আচরণ ও চলাফেরায় ডাক্তাররা রীতিমতো আতঙ্কিত। তারা বলছেন, যে যেখানে আছে সেখানেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশগুলো হিমশিম খেয়েছে। তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কোনো কোনো দেশ কারফিউ দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ঐ সব দেশ স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে। বর্তমানে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এসব উন্নত দেশের তুৃলনায় বাংলাদেশের চিকিত্সাসেবার সক্ষমতা কম। তাই ঐ সব দেশের মতো করোনা পরিস্থিতি বাংলাদেশে হলে তা মোকাবিলা করা কঠিন হবে।

এবার করোনার তৃতীয় ঢেউ এলে দেখা যাবে চিকিত্সার অভাবে বাবার কোলে সন্তান, সন্তানের কোলে বাবা-মা মারা যাচ্ছেন। কেউ ভেবে দেখছেন না, একবার গ্রামে ঈদ না করলে কী হয়? মানুষের ঢেউ গ্রামমুখী, তারা আবার ঈদের পর ঢাকায় আসবে। এতে করোনা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়বে। তখন চিকিত্সাসেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।

গত মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল। আইসিইউ পাওয়া যাচ্ছিল না। তৃতীয় ঢেউ এলে পরিস্থিতি হবে আরো করুণ।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। আমরা দিনের পর দিন বলেই যাচ্ছি, কেউই শুনছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে সামনে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসার সম্ভবনা বেশি। তখন পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। রোগী বেড়ে গেলে অক্সিজেনের অভাব হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে অবহেলা আমাদের যে কতটা ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে, তা এখন কেউ বুঝতে পারছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক বলেন, আমরা সব সময় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি, স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনুনয়-বিনয় করছি। কিন্তু কে শুনে কার কথা। ঈদে গ্রামমুখী মানুষের ঢল, ঈদের পর তারা আবার ঢাকায় ফিরবে। তখন কী যে হবে আল্লাহ জানে। তবে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংক্রমণ বিস্ফোরণ হতে পারে। তিনি বলেন, করোনা মোকাবিলা করতে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। উন্নত দেশের তুলনায় আমরা কিছুই না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের অনেক চিকিত্সক করোনায় মারা গেছেন। আর তৃতীয় ঢেউ আসলে কী হবে তা কল্পনা করা যাচ্ছে না। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, বারবার সতর্ক করা হলেও কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না। একবার ঈদে গ্রামের বাড়িতে না গেলে কী হয়? কিন্তু গ্রামমুখী মানুষের ঢল নেমেছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রামে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এটা চরম ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ঈদের পর তিন চার দিন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যে যেখানে আছে, তাকে সেখানেই রাখতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে ভয়াবহ বিপদ। তৃতীয় ঢেউ এলে কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে আমাদের।

স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, ঈদ সামনে রেখে যেভাবে গ্রামমুখী মানুষের ঢল নেমেছে, তাতে ঈদের পর করোনার বন্যা হওয়ার আশঙ্কা। জাতীয় পরামর্শক কমিটির ১৪ দফার ভিত্তিতে লকডাউন শিথিল করা হলেও কেউই তা মানছে না। এমন অবস্থার মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউ এলে অক্সিজেনের সংকট দেখা দেবে। চিকিত্সা তো পাবেই না। তাই সবারই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

আইইডিসিআরের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, গণপরিবহন, ফেরিঘাট ও দোকানপাট—এই তিন জায়গায় ঝুঁকি বেশি। ঈদের পর সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা। সব কাজ স্বাস্থ্যবিধি মেনে করা সম্ভব। কিন্তু আমরা কেউই তা করছি না। এতে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছি। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।