ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি বন্ধ আছে। এখন ভারতও গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে, যা ভোগ্যপণ্যের বাজারে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।সাধারণত ইউক্রেন ও রাশিয়া বাংলাদেশের গম আমদানির শীর্ষ দেশ হলেও যুদ্ধ শুরুর পর গত মার্চ থেকে সেই জায়গায় উঠে এসেছে ভারত। কিন্তু এখন প্রতিবেশী দেশটি থেকেও গম না পেলে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিবে বাংলাদেশ সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে দ্রুত বিকল্প বাজার খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন বেসরকারি খাতের গম আমদানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু সমস্যা হলো ভারতের তুলনায় ক্যানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে গমের দাম বেশি। তাই সেখান থেকে গম আনলে দাম অনেক বেশি পড়বে।বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে যারা গম আমদানি করে তাদের মধ্যে টিকে গ্রুপ অন্যতম। এই গ্রুপের ঊর্ধ্বতন পরিচালক তারিক আহমদে বলেন, ‘গমের বিকল্প উৎস আছে কিন্তু দাম অনেক বেশি। ভারতে যেমন এখন প্রতিটন ৪০০ ইউএস ডলার। কিন্তু ক্যানডায় ৫৪০ ইউএস ডলার। অষ্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানির গমের দামও বেশি। দামের তুলনা করলে এই সময়ে ভারতের কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। আমরা যা শুনেছি তাতে ভারতের গম সরকার টু সরকার হয়তো আমদানি করা যাবে।’ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করলেও এখন পর্যন্ত যে এলসি খোলা হয়েছে সেই গম সরবরাহ করা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া কোনো দেশ খাদ্য সংকটে পড়লে ভারত সরকার চাইলে সেই দেশে গম রপ্তানির আদেশ দিতে পারে। প্রতিবেশি দেশগুলোর জন্য তারা সরকারি পর্যায়ে গম রপ্তানির একটা ব্যবস্থাপনাও রেখেছে।বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ভারত থেকে তিন লাখ টন গম আনার জন্য এরইমধ্যে চুক্তি করা হয়েছে। যার মধ্যে এক লাখ টন মঙ্গলবার আসার কথা।মজুত সংকট নেইবাংলাদেশে এখন বছরে গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১১ লাখ টন। সাধারণত রাশিয়া, ইউক্রেন, ক্যানাডা ও ভারত থেকে আমদানি করে বাকি ঘাটতি মেটানো হয়।গত অর্থবছরে মোট আমদানি করা গমের মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে শতকরা ৪৫ ভাগ, ক্যানাডা থেকে ২৩ ভাগ এবং ভারত থেকে ১৭ ভাগ গম আমদানি করা হয়েছে। বাকি ১৫ ভাগ গম আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা ও অষ্ট্রেলিয়াসহ আটটি দেশ থেকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমদানিচিত্র পাল্টে যায়। ১ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত গম আমদানির যে হিসাব তাতে ভারত শীর্ষে আছে। এই সময়ে ছয় লাখ ৮৭ হাজার টন গম আমদানি করা হয়। যার মধ্যে ভারত থেকে শতকরা ৬৩ ভাগ, ক্যানাডা থেকে ১৪ ভাগ আর অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয় ২৩ ভাগ।টিসিবির পণ্য বিক্রি ৩০ মে পর্যন্ত স্থগিত টিসিবির পণ্য বিক্রি ৩০ মে পর্যন্ত স্থগিত
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আমদানি হয়েছিল ৫৩ লাখ ৪২ হাজার টন।বাংলাদেশে বেসরকারি খাত ছাড়াও সরকার তার বিভিন্ন কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের জন্যও গম আমদানি করে। গত অর্থ বছরে সরকার সরাসরি গম আমদানি করেছে প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার টন। চলতি অর্থ বছরে এপর্যন্ত আমদানি করেছে চার লাখ ৭৮ হাজার টন। বর্তমানে সরকারের কাছে মজুত আছে এক দশমিক এক-আট লাখ টন গম।বাড়ছে দামবাংলাদেশে চালের বিপরীতে খাদ্য হিসেবে গমের ব্যবহার বাড়ছে। এখন বছরে তিন কোটি ৫০ লাখ টন চালের চাহিদার বিপরীতে গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন। গমের আটা ও ময়দা থেকে রুটি ছাড়াও নানা ধরনের ব্রেড, বিস্কুট ও বেকারি পণ্য তৈরি হয়। এসব খাদ্য পণ্যের উপর নির্ভর করেন নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এরইমধ্যে আটা ময়দার দামে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এক বছর আগের চেয়ে কেজিতে প্যাকেটজাত আটার দাম ১০ টাকা আর ময়দায় বেড়েছে ২০ টাকার মতো।টিকে গ্রুপের ঊর্ধ্বতন পরিচালক তারিক আহমদে বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের আগে গত বছরের দামের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় গমের আমদানি মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তখন ভারতের গম ছিলো প্রতি টন ২০০ ডলার, কানাডার ২৮০ ডলার। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গমের পর্যাপ্ত মজুত থকলেও এরই মধ্যে আটা ও ময়দার দাম বেড়ে গেছে। প্যাকেটজাত আটার দাম প্রতি কেজি ৪৭ টাকা এবং ময়দা ৬৫ টাকা। কিন্তু গত বছরের শেষ দিকে আটা ছিলো ৩৫ টাকা এবং ময়দা ৪৫ টাকা কেজি।’সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ‘ভারত থেকে সরকারি পর্যায়ে গম আমাদানির চেষ্টা ছাড়াও বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ বাজার নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বিকল্প উৎস থেকে গম আমদানির চেষ্টা করতে হবে। তবে ভোক্তাদেরও বেশি দামে কেনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। কারণ এই সংকট এখন বিশ্বব্যাপী।’গম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা ভারতেরগম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা ভারতের
তবে সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে তিনি সরকারের তৎপরতার ওপরও জোর দেন। ভোজ্য তেলের মতো সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ‘সরকাররে বাণিজ্য এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়কে এখনই আমদানিকারকদের সাথে বসতে হবে। বসে মজুতের অবস্থা, আমদানি পরিস্থিতি সবকিছু পর্যালোচনা করতে হবে। আর সরকার উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য যে গম আমদানি করে সেটাও বাড়াতে পারে। এসব করতে হবে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে,’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ।এদিকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সিলেটে খাদ্য গুদাম পরিদর্শনে গিয়ে রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘ভারত বেসরকারি পর্যায়ে গম রপ্তানি বন্ধ করেছে, সরকারি পর্যায়ে করেনি। আমরা সম্প্রতি ভারত থেকে তিন লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করেছি। আর এখন তারা হয়তো বন্ধ করেছে, ১০ দিন পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। এটা নিয়ে কোনো সংকট হবে বলে মনে করি না।’