ফারুক আহমেদ ঃ আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। বাঙালির আবহমান জীবনধারায় এক বিশেষ তাৎপর্যময় দিন। ঋতুর পরিক্রমায় চৈত্র অবসানে বিবর্ণ, বিশীর্ণ, জীর্ণ অতীতকে পশ্চাতে ফেলে নতুন বছরের নতুন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে পহেলা বৈশাখ। এসেছে আজ নববর্ষের সমুজ্জ্বল শুভক্ষণ। বাঙালির আবেগ ও ভালবাসায় মিশে আছে বাংলা নববর্ষ। সব ধর্মের মানুষকে এক মঞ্চে আনার শাশ^ত কোন উৎসব যদি থেকে থাকে তা’ হলো বাঙালির পহেলা বৈশাখ। বাংলার নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তাই বাঙালী মেতে উঠেছে বর্ষবরণে। পহেলা বৈশাখ বাঙালীর জাতীয় উৎসব। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন।
পহেলা বৈশাখের মধ্য দিয়ে আজ বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩০। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’ এভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে এ আহ্বান জানায় বাঙালি। পয়লা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। অন্য দিকে পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল স¤্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন গণনার শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার।
মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা’ পরিচিত হয় ‘বঙ্গাব্দ’ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলা বর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা’ বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে বাঙালী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বৈচিত্রময়। আবহমানকাল ধরে এ সব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবের মাধ্যমে বাঙালী তার অস্বিত্ব ও স্বাতন্ত্রের পরিচয় দিয়ে আসছে। বাঙালীর উৎসবগুলির মধ্যে সার্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক সর্ববৃহৎ মিলনমেলা ও উৎসব হলো এ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ বাঙালী জীবনের এক অনবদ্য আনন্দের উৎসও বটে। নববর্ষ নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা। কাল- বৈশাখীর তান্ডব উড়িয়ে নিয়ে যায় জীবনের ব্যর্থ সঞ্চয়ের জীর্ণস্তুপ। নববর্ষ হয় অনিশ্চিতের সুনিশ্চিত সম্ভাবনার আহবান। এই দিনে চির নতুনের প্রথম গানে বিকশিত হয়ে ওঠে সবার জীবন। নববর্ষ জীবনের তুচ্ছতাকে পশ্চাতে ফেলে নতুন আনন্দে যুক্ত হওয়ার এক অবিনাশী প্রত্যয়।
নববর্ষে পুরাতন বছরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রির অন্তিম প্রহর সমাপ্তি হয়। তিমির রাত্রি ভেদ করে পূর্ব দিগন্তে উদীত হয় নতুন দিনের জ্যোর্তিময় সূর্য। প্রকৃতির নিসর্গ মঞ্চে ধ্বনিত হয় নবজীবনের সঙ্গীত। আকাশ সজ্জিত হয়অপরূপ সাজে। পত্রে পত্রে তার পূলক শিহরণ। গাছে গাছে তার আনন্দ উচ্ছ্বাস। পাখির কন্ঠে কন্ঠে নবপ্রভাতের বন্দনা গীতি। অভিনন্দন ধ্বনিতে নবপ্রভাতের বন্দনাগীতি। এ শুভ দিনের উদার অভ্য্যুদয়ে মানুষের হৃদয়-উৎসারিত। নতুন দিনের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা, প্রার্থনা দুঃখজয়ের।
নববর্ষ আমাদের সামনে সম্ভাবনার যে নতুন আহবান নিয়ে এসেছে তাকে জীবনের আনন্দ ও কল্যাণে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করতে হবে। নববর্ষের উৎফুল্ল মিলনোৎসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সামষ্টিক চেতনা ও মানবিক চেতনা যেন আরো উজ্জীবীত হয়। আমরা যেন ধর্ম,বর্ণ, গোত্র- চেতনার ঊর্ধ্বে ওঠে পারস্পরিক প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিনির্মাণ করতে পারি সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামী।
খুলনায় বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কর্মসূচি ঃ পহেলা বৈশাখ-১৪৩০ বঙ্গাব্দ যথাযোগ্য মর্যাদা ও আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপনের লক্ষ্যে খুলনার বিভিন্ন প্রশাসনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় পহেলা বৈশাখ উদয়াপন করা হবে। খুলনা জেলা প্রশাসন বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। সকাল নয়টায় খুলনা রেলওয়ে স্টেশন প্রাঙ্গণ থেকে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়ে খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে শেষ হবে। খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের আয়োজনে খুলনা প্রেস ক্লাবে পহেলা বৈশাখের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সকাল সাড়ে নয়টায় শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হবে। পহেলা বৈশাখে জেলখানা ও সরকারি শিশু পরিবার ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে, জেলা কয়েদিরা বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবে। সকাল সাড়ে নটায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বর্ষ বরণ অনুষ্ঠান শুরু হবে। উদিচী শিল্পী গোষ্ঠি খুলনার আয়োজনে সকাল সাড়ে ছয়টায় সার্কিট হাউজ মাঠের উত্তর পাশে কোর্টের সন্মুখে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান শুরু হবে। নগরীর হাদিস পার্কে গানের তরীর আয়োজনে সকাল সাড়ে ৬টায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল সাড়ে দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য বাংলা চত্বরে বর্ষ-আবাহন এবং সকাল এগারোটায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হবে। রূপান্তরের আয়োজনে সকাল সাড়ে ৭টায় রূপান্তর কার্যালয়ে আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সকাল ৯টায় বর্ণাঢ্য র‌্যালী বের করা হবে।