#ডিএনএ প্রোফাইলের মত আধুনিক ব্যবস্থাপনায় বৈশ্বিক উদ্যোগে গুরুত্বরোপ
#২০২৮ সালের মধ্যে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১৪৫-এ উন্নীত করার আশাবাদ
ফারুক আহমেদ: এক সময়ে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি ছিল না। বরং নানা মত ছিল এ সংখ্যা নিয়ে। কারণ অত্যন্ত দুর্গম এই বনাভ্যন্তরে প্রবেশ করে অতি হিংস্র ও দর্পশালী এ প্রাণীর গণনা করা খুবই দুঃসাধ্য একটি বিষয় ছিল। তখন পায়ের ছাপসহ বাঘের উপস্থিতি অনুমান করে অথবা বনের আশপাশের অধিবাসীদের মুখের কথার উপর ভিত্তি করে এ প্রাণীটির গণনা করা হতো। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জরিপে বাঘের সংখ্যার নানা রকমের সংখ্যার কথা জানা যায়।
পরবর্তীতে ২০১৫ সালে শুরু হয় ক্যামেরা ট্রাপিং এর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক গণনা। ২০২৩-২৪ সালের সর্বশেষ গণনা অনুযায়ী বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বলা হয় ১২৫টি। এ সংখ্যায় আত্মতৃপ্তির সুযোগ যেমন নেই তেমনি এই সংখ্যাটিকে টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
অন্যদিকে বন বিভাগের সূত্র এ সংখ্যায় সন্তোষ প্রকাশ করে আগামী ৪ বছরে এ সংখ্যা ১৪০ হতে ১৪৫ এ উন্নীত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। বন বিভাগের সংখ্যাকে ধরে রাখা এবং আগামীর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো চ্যালেঞ্জ হলো- বাঘ ও হরিণের চোরা শিকার, বনের অবক্ষয়, জলবায়ু অভিঘাত, বনের উপর মানুষের অতিনির্ভরশীলতা ইত্যাদি। এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করা না গেলে বাঘের আবাসস্থল থাকবে না। এমনি অবস্থায় বাঘকে রক্ষা করা যাবে না- অভিমত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক এবং ইনিস্টিটিউট অব ফরেস্টারর্স বাংলাদেশের জয়েন্ট সেক্রেটারী প্রফেসর ড. নাজমুস সাদাত বলেন, বাঘ সংরক্ষণে সব চেয়ে বেশী জরুরী বাঘের আবাসস্থলের প্রতিবেশ ব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা। দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাঘ সংরক্ষণ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ডিসিপ্লিনভিত্তিক দক্ষ ব্যবস্থাপক দিয়ে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। তিনি বলেন, কোর জোন (ঈড়ৎব তড়হব) এবং বাফার জোন (ইঁভভবৎ তড়হব) কনসেপ্ট সুন্দরবেনে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই কনসেপ্ট জীবমন্ডল সংরক্ষণাগার (ইরড়ংঢ়যবৎব জবংবৎাব) বিবেচনায় সুন্দরবনের অভয়ারণ্যের বাঘ রক্ষায় কাজ করতে পারে।
তিনি বলেন, বাঘের আবাসস্থলের প্রশ্ন আসলে প্রথমেই আমাদের জোনেশন বা জোনিং কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কোর জোন এবং বাফার জোনের পার্থক্য ঠিক করতে হবে। এই দুটি জোন একাকার হলে হবে না। বাঘের জন্য ‘কোর জোন’ নির্ধারণ করতে হবে যা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত এলাকা হিসেবে নির্দিষ্ট থাকবে। যেখানে মানুষের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকতে হবে। সত্যিকার অর্থে কোর জোনকে হতে হবে বন্যপ্রাণী এবং বাস্তুতন্ত্রের নিরাপদ স্থল।
অন্যদিকে, কোর জোনকে ঘিরে থাকবে বাফার জোন। এখানে কিছু সীমিত মানবিক কার্যকলাপ যেমন-পর্যটন, গবেষণা এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই কার্যকলাপের চলতে পারে। কোর জোন এবং বাফার জোন উভয়ই সুন্দরবনের বাঘসহ জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অপর শিক্ষক শিক্ষক প্রফেসর ড. ওয়াসিউল ইসলামের মতে, বাঘের জন্য প্রধানত বাঘের আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে হবে। দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাঘের আবাসস্থলের পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং বাঘের শিকার প্রাণী সংরক্ষণ করতে না পারলে কোন উদ্যোগই সুন্দরবনের বাঘ রক্ষা করতে পারবে না। তিনি বলেন, সুন্দরবনের হরিণ, বাঘের প্রধান খাবার। সুন্দরবনে চোরাই হরিণ শিকার বন্ধ হয়নি। হরিণ শিকার মানে বাঘের খাবারে টান পড়া। বাঘের খাবারের সংকট হলে বাঘ খাবারের সন্ধানে তার টেরিটরি বা হোমরেঞ্জ বড় করতে সচেষ্ট হয়। তখন শুরু হয় অন্য বাঘের সাথে টিকে থাকার লড়াই। কারণ বৈশিষ্টগতভাবেই বাঘ যেহেতু একই এলাকায় অপর একটি বাঘের অস্বিত্ব মেনে নেয় না এবং নিজের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্ধে বা যুদ্ধে লিপ্ত থেকেই জীবনপ্রক্রিয়া চালায় সেহেতু বড় হোমরেঞ্জ মানেই বাঘের সংখ্যা কমার আশংকা। সেক্ষেত্রে খাবারের প্রাচুর্যতা থাকলে বাঘের হোমরেঞ্জও ছোট হয়। এতে বাঘের বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ কমে আসে। যার ফলে বাঘের সংখ্যাগত দিকে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তিনি বলেন, বাঘের সংখ্যা কত হবে এটি প্রকৃতি নির্ধারণ করে। এখানে মনুষ্য করণীয় তেমন কিছু নেই। তবে বাঘের আবাসস্থলের বৈশিষ্ট ঠিক রাখতে হবে কঠোর এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা কত এবং ২০২৮ সাল নাগাদ পরবর্তী গণনায় সংখ্যা কত হতে পারে- এমনি প্রশ্নের উত্তরে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) এবং সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রধান এজেডএম হাসানুর রহমান বলেন, নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে হলেও সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে ১২৫টি বাঘ রয়েছে। এ সংখ্যা ২০২৮ সাল নাগাদ ১৪০ থেকে ১৪৫টি হবে বলে আমরা আশাবাদি।
তার মতে, ২০২৩-২৪ সালে যখন সর্বশেষ ক্যামেরা ট্যাপিং করে গণণা হয়েছিল তখন ২২টি বাঘের শাবককে নিয়ম অনুযায়ী গণনায় আনা হয়নি। সুতরাং এই শাবকগুলি পূর্ণবয়স্ক হয়ে আগামী গণনায় চলে আসবে। এছাড়াও এ সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়ায়ও বাঘের সংখ্যা বাড়বে। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ভাল অবস্থার দিকেই যাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, কিছু দিন পূর্বেও পৃথিবীর ১৩টি দেশে বাঘ ছিল। এখন আছে ১০ দেশে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের বনাঞ্চল হতে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বাঘের সংখ্যা মাত্র ৩৮৪০টি।
সুন্দরবনে বাঘের টেকসই আবাসস্থলের জন্য বন বিভাগের কি কি উদ্য্যোগ রয়েছে- এমনি প্রশ্নে তিনি বলেন, বাঘের পরজীবী সংক্রমণ, অন্যান্য সংক্রমণ ব্যধি ইত্যাদির মাত্রা নির্ধারণ কার্যক্রম, বাঘ এবং হরিণ শিকারপ্রবণ ২৫টি ‘হটস্পট’ এলাকা নির্ধারণ এবং ক্যামেরা ট্যাপিং এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ,‘বাঘ-মানুষ’ দ্বন্দ্ব নিরসনে ঝুঁকিপূর্ণ ৭৪ কিলোমিটার এলাকায় বেষ্টনি নির্মাণ, বাঘ এবং শিকার প্রাণীর জন্য কিল্লা স্থাপন, বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির জন্য পুকুর খনন ইত্যাদি কার্যক্রমে বাঘের আবাসস্থলকে টেকসই করতে ভূমিকা রাখছে।
জানা যায়, সুন্দরবনে বাঘের খাবারের ৮০ শতাংশ আসে হরিণ, ১০ শতাংশ শুকর, ৪ শতাংশ বানর এবং অন্যান্য উৎসে ৬ শতাংশ। সুতরাং বাঘের টিতে থাকা এবং বংশ বৃদ্ধির জন্য এই শিকার প্রাণীর সংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিকার প্রাণীর সংখ্যা ভারসাম্যহীন হলে বাঘের অস্বিত্ব সংকটপূর্ণ হতে বাধ্য।
এ প্রসঙ্গে একজন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ বলেন, সুন্দরবনে বাঘের শিকার প্রাণীর সংখ্যা এখন অপেক্ষাকৃত ভাল এবং ভারসাম্যপূর্ণ। তবে এ ধারা বজায় রাখতে কঠোর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরী। এক্ষেত্রে চোরা শিকারীদের অপতৎপরতা নির্মুল করতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এম এ আজিজের ২০২৪ সালের এক গবেষণা সূত্রে তিনি জানান, সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী সুন্দরবনে এখন কমবেশী ১ লক্ষ ৩৬ হাজারের বেশী হরিণ, ৪৭ হাজার ৫শ’ শুকর, ১ লক্ষ বায়ান্ন হাজার বানর, ২৫ হাজার গুই সাপ, ১২ হাজার ২শ সজারু, ২০-২৫ হাজার ভোদড় রয়েছে।
বন বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত প্রায় আড়াই দশকে (২০০১ সাল হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত) ৬১টি বাঘ বিভিন্ন কারণে মারা যায়। এর মধ্যে লোকালয়ে চলে আসায় স্থানীয় মানুষ পিটিয়ে মেরেছে ১৪টি, দুস্কৃতকারীরা হত্যা করেছে-২৬টি, স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ১৯টি এবং সিডরসহ প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু-২টি বাঘের।
এদিকে বাঘ সংরক্ষণে আরও আধুনিক কী উপায় রয়েছে- এমনি প্রসঙ্গে একটি সূত্র জানায়, যেহেতু বাঘ সুন্দরবনে মহাবিপন্ন প্রাণী এবং বাঘের একটি ঐতিহ্যগত দিক রয়েছে যেটি আন্তুর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেহেতু বাঘের অস্বিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাঘের ‘ডিএনএ’ প্রোফাইল করা যেতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে এটি করা অসম্ভব মনে হলেও এটিকে বৈশ্বিক উদ্যোগের অংশ করা গেলে তা’ সম্ভব হতে পারে। বিষয়টি উপেক্ষা না করে এর সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এ বিষয়ে গবেষণা বা ভাবনার ক্ষেত্রটি প্রসারিত করা যেতে পারে। সূত্রটি মতে, ‘ডিএনএ’ প্রোফাইল বাঘ সংরক্ষণের কার্যক্রম সহজ করে দিতে পারে। এতে করে বাংলাদেশের বাঘ বা বাঘের দেহের খন্ডাংশ বা অঙ্গপ্রতঙ্গের অংশ বিশেষ বিশ্বের যেখানেই পাচার হোক না কেন তা’ চিহ্নিত করা যাবে। এতে বাঘের চোরাই শিকার বা পাচার কমানো যাবে। বাঘের সংখ্যাগত হেরফের বোঝা যাবে। বাঘের স্বাস্থ্য এবং রোগবালাই সম্পর্কে জানা যাবে। বাঘের প্রজনন সংক্রান্ত বিষয়াদিসহ বাঘের জীবিত অবস্থার বর্ণনা এবং মরে গেলেও কারণ জানা যাবে। সার্বিক অর্থে বর্তমান বিশ্বে মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে বিবেচিত এই অতি হিংস্র অথচ রাজকীয় প্রাণীটিকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য আবাসস্থলে টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা সহজ হবে।
সূত্রটি মতে, ডিএনএ (উঘঅ) হলো ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (উবড়ীুৎরনড়হঁপষবরপ অপরফ) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ডিএনএ-তে জিনগত তথ্য থাকে যা একটি জীব তার পিতামাতা থেকে পেয়ে থাকে এবং যা সেই জীবের গঠন ও কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু ডিএনএ জীবন্ত প্রাণীর বৃদ্ধি, বিকাশ, এবং কার্যাবলীসহ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত নির্দেশাবলী ধারণ করে সেহেতু বাঘ সংরক্ষণের বৈশ্বিক উদ্যোগ হিসেবে এটি ওয়াল্ড টাইগার ফোরামের ব্যবস্থাপনায় গ্রহণ করার বিষয়ে বাংলাদেশ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।