সোহেল মাহমুদ ॥ ঘরে ঘরে চলছে নবান্নের উৎসব। চারদিকে কুয়াশায় ঢাকা প্রকৃতি, শীত যেন জেঁকে বসেছে। চলছে পিঠাপুলি উৎসব! পৌষের হিমেল হাওয়ায় পিঠা ছাড়া বাঙালির ঐতিহ্য ভাবাই যায় না। পিঠা বাংলা সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। নতুন চাল আর খেজুর গুড়ের নানা স্বাদের পিঠা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। সারা বছর পিঠা পাওয়া গেলেও শীতকালকেই পিঠার মৌসুম বলা চলে। কারণ, এ সময়ে খেজুরের রস, গুড় আর নতুন চাল পাওয়া যায়। শীতকালে দেশের গ্রাম ও শহরে পিঠা তৈরি হয়। পিঠা সাধারণত চালের গুড়ি ও গুড় দিয়ে তৈরি হয়। এ ২টি মূল উপাদানের সাথে নারকেল ও মশল্লাও দেওয়া হয়। এলাকা ভেদে দেশে বিভিন্ন বাহারী নামের পিঠা রয়েছে। তবে সবার প্রথমে রয়েছে চিতই পিঠা। এছাড়া রয়েছে ভাপা, পুলি, পাটিসাপটা, নকশি, পাকান, সেমাই কুলি, বিবিখানা, লবঙ্গ লতিকা, ফুলঝুরিসহ নানা নামের পিঠা।
পৌষ সংক্রান্তিতে শীতের পিঠার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চিতই, ভাপা ও রসের পিঠা। শীতকালে পুরো দেশ জুড়ে ভাপা ও চিতই পিঠার আধিক্য থাকলেও রসের পিঠা গ্রামেই বেশি দেখা যায়। খেজুর রসের সাথে দুধ আর নারকেল দিয়ে, রসের পিঠা ও পায়েসের যে স্বাদ, তার বর্ণনা করে খুলনার সাংস্কৃতিক কর্মী কাজল ইসলাম বলেন, কাঁচা রসের পায়েস সত্যিই অসাধারণ। তিনি বলেন, শীত মানেই বাঙালীর চিরায়ত পিঠা-পুলির সময়। এখনও বাংলার গ্রামে ঘরে ঘরে পৌষ সংক্রান্তির পিঠা উৎসব হলেও শহরে তার খুব একটা দেখা মেলেনা। তবে নতুন করে আবার নগর জীবনে পিঠার প্রচলন শুরু হয়েছে।
গ্রামবাংলার চিরন্তন এই ঐতিহ্য মেনে ঘরে ঘরে চলছে পিঠা তৈরির ধুম। এই পিঠা ঘরের মানুষ তো বটেই, আত্মীয়স্বজন পড়শিদের ও খাওয়ানো হয়। খুলনার রূপসা উপজেলার সামন্তসেনা গ্রামের কৃষ্ণা দাস বলেন, পৌষ সংক্রান্তিতে বাড়িতে পিঠা তৈরী হয়। যা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ সবাইকে দেওয়া হয়। আমরাও সবার বাড়ীতে যায় পিঠা খেতে। গ্রামের মত শহরেও পিঠার জনপ্রিয়তা রয়েছে। শহরের মোড়ে মোড়ে সড়কের উপর শীতকালে দেখা যায় পিঠার অস্থায়ী দোকানের পশরা। নগরীর জাতিসংঘ পার্কের পাশে ৩২ বছর আগে থেকে পিঠা বিক্রি করেছেন বরগুনার শামসুল হক। তার মৃত্যুও পর এখন পিঠা বিক্রি করছেন তার ছেলে রুহুল আমিন। রুহুল আমিন বলেন, “৩০বছরেরও বেশী আমরা এখানে পিঠা বিক্রি করছি। বটিয়াঘাটার সুগন্ধি বেনাপোল আতপ চালের গুড়ি দিয়ে ও ভালো মানের খেজুরের গুড় দিয়ে আমরা পিঠা তৈরী করি। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরী করার কারনে নগরীর বহু দূর থেকেও মানুষ আমাদের তৈরী পিঠা নিতে আসে।” তিনি বলেন, “নানা রকমের উপকরণের প্রয়োজনে শহরে এখন আর কেউ পিঠা বানাতে চায় না। সবাই দোকান থেকে পিঠা কিনে নানাভাবে পরিবেশন করে থাকেন। আগে বিক্রি ভালো ছিল, বর্তমানে দিনে সাত/আট হাজার টাকা বিক্রি হয়।”
পিঠা কিনতে আসা নগরীর গোবচাকার মো নজরুল ইসলাম বলেন, বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী খাবার পিঠা। দীর্ঘদিন এখান থেকে পিঠা কিনি। পরিচ্ছন্ন হওয়ায় অনেক মানুষ দূর-দূরন্ত থেকে এখানে আসেন পিঠা নিতে। তিনি বলেন, এখনকার গৃহবধুরা আর বাড়ীতে পিঠা তৈরী করতে চায়না। যে কারনে এখান থেকে পিঠা কিনে বাড়ীতে রস তৈরী করে পরিবেশন করেন। তিনি বলেন বাঙালীর এই ঐতিহ্যটা টিকে থাকুক।
পিঠা কিনতে আসা কেশবপুরের ছাত্রী অর্পা মল্লিক বলেন, এখানে হোস্টেলে থাকি চাইলেও পিঠা বানানোর সুযোগ নেই এজন্য এখান থেকে পিঠা নিতে এসছি। তিনি বলেন, পিঠার স্বাদ ভালো। মনে হয় বাড়ীতে বসেই পিঠা খাচ্ছি।
কুড়িগ্রাম থেকে খুলনায় আসা নুর ইসলামের ছেলে ভাপা পিঠা বিক্রেতা বাবর হাসান বলেন, ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে তিনি খুলনায় ভাপা পিঠা বিক্রি করছেন। গতবছর দিনে ৩/৪ হাজার টাকা বিক্রি হলেও এবছর দিনে দেড় দুই হাজারের বেশি বিক্রি হচ্ছেনা। করোনার কারনে অনেকেই বাইরের খাবার খাচ্ছেনা।
নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় বাসায় পিঠা বানানো অনেকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠে না। এ কারণে এখন অনেকেই অনেক অভিজাত শপিংমল, ফেসবুক গ্রুপ বা ওয়েবসাইট-এ অনলাইনে অর্ডার দিয়েও পিঠার স্বাদ নিয়ে থাকেন। কর্মব্যস্ততার মাঝে দেশের ঐতিহ্যের কাছাকাছি যেতে শহরেও বর্তমানে বিভিন্ন পিঠা উৎসব, পিঠা মেলার আয়োজন করা হয়। নগরীর বানিয়া খামারের মাহফুজা আক্তার মিলি বলেন, তাদের সংগঠন থেকে প্রতি বছর জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন পিঠা মেলার স্টলে তিনি পিঠা বিক্রি করেন। তিনি বলেন, শহরের মানুষের পিঠার উপর আগ্রহ আছে। তবে পিঠার আনুসঙ্গিক বিভিন্ন উপকরণের অভাবে এখন আর কেউ বাড়িতে পিঠা বানাতে চান না। তবে নগরীর বিভিন্ন মেলায় পিঠার বেচা-বিক্রি ভালো।
পিঠার জন্য প্রয়োজনীয় চালের গুড়ি, খেজুরের গুর, রস, পিঠার ছাচসহ উপকরণের অভাবে ক্রমেই আমাদের নিজ বাড়িতে পিঠা তৈরির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, পিঠা আমাদেরই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। এই ঐতিহ্যের ধারাহাহিকতা ধরে রাখার পাশাপশি এটির আধুনিকায়ন করে সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য হিসেবে হড়ে তোলা সম্ভব। যা বাঙালী সমাজে গড়ে তুলবে আত্মীয়-স্বজন ও মানুষে-মানুষে পারস্পরিক সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধন।