ফার্নেস অয়েলের ওপর আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব বিদ্যুত উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি করেছে। উৎপাদন খরচ মেটাতে সরকারকেই ভর্তুকি দিতে হবে অন্যথায় ভোক্তার কাছ থেকে দাম বাড়িয়ে অর্থের সংস্থান করতে হবে। বিশ^বাজারে নিম্নমুখী তেলের দরে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমার বদলে দেশে বৃদ্ধির প্রক্রিয়া অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে অতিরিক্ত চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বাড়তি গুণতে হবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় তেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ নিরুৎসাহিত করতে ফার্নেস তেলের ওপর আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেন। এত দিন বিদ্যুত উৎপাদনের জ্বালানি আমদানিতে কর ছাড় দেয়া হয়েছে। এমনকি এলএনজির ওপরও বড় রকমের কর ছাড় দিয়েছে সরকার। শুধু বিদ্যুতের জ্বালানিই নয় কেন্দ্র নির্মাণের যন্ত্রাংশ আমদানি এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর্পোরেট করও দিতে হয় না। সরকারের এই সব নীতির কারণে দেশের বিদ্যুত খাত দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছে। ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভবিষ্যত পথপরিক্রমা’ শীর্ষক বাজেট বক্তৃতার ২০২ অনুচ্ছেদে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে দ্রুত বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জরুরী ভিত্তিতে ফার্নেস অয়েল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই পরিস্থিতিতে ২০১১ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কম রাখার জন্য ফার্নেস অয়েলের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক তুলে দেয়া হয়। কিন্তু এখন বিকল্প জ্বালানি ভিত্তিক অনেকগুলো বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে এই পরিস্থিতিতে ফার্নেস অয়েলের শুল্ক তুলে নেয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে। এতে ফার্নেস অয়েল চালিত কেন্দ্র স্থাপন নিরুৎসাহিত হবে বলে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন পর্যায়ে দুইভাবে দাম হিসেব করা হয়। একটি জ্বালানি ব্যয় অন্যটি অজ্বালানি ব্যয়। বিদ্যুত কেন্দ্র সরকারী হোক বা বেসরকারী তেলের মূল্য সরকারকেই পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ বিদ্যুত উৎপাদনের তেলের দাম বৃদ্ধি বা কমার সঙ্গে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এমনিতেই সরকারকে প্রতিবছর বিদ্যুত খাতে বড় রকমের ভর্তুকি দিতে হয়। এই কর পরিশোধ করতে হলে আরও অতিরিক্ত করের বোঝা চাপবে বিদ্যুতের ওপর। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়লে পিডিবি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এর কাছে দাম বৃদ্ধির আবেদন করে। এক্ষেত্রে বিইআরসি বর্ধিত খরচের একটি অংশ গ্রাহকের কাছ থেকে অন্য অংশটি সরকারকে ভর্তুকি হিসেবে দেয়ার জন্য সুপারিশ করে। গতবার দাম বৃদ্ধির সময় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঘাটতি থাকার কথা বিইআরসির তরফ থেকে জানানো হয়। বিদ্যুত সচিব ড. সুলতান আহমেদ বিষয়টি নিয়ে জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারছেন না। দেশে তেল চালিত দুই ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। ফার্নেস অয়েল ছাড়াও দেশে ডিজেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। ফার্নেস অয়েলে বিদ্যুত উৎপাদন খরচের তিনগুণ উৎপাদন খরচ হয় ডিজেলে। অন্যদিকে এখনও কেবলমাত্র এলএনজি ভিত্তিক কোন বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসেনি। তবে এলএনজিকে জাতীয় গ্রীড থেকে গ্যাসের দামে কিনে বিদ্যুত উৎপাদন করছে কেন্দ্রগুলো। তবে আলাদা করে শুধু মাত্র এলএনজি হিসেবে কেন্দ্র নির্মাণ করলে তার দামও ফার্নেস অয়েলে উৎপাদিত বিদ্যুতের কাছাকাছি আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দেশে কেন্দ্রগুলোর যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার হিসেব দিয়েছে তাতে দেখা গেছে এবার ২০ হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। সরকার বাজেটেও বিদ্যুতখাতের ভর্তুকি হিসেবে আট হাজার কোটি টাকা রেখেছে। কিন্তু এই ভর্তুকিকে যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে না। অর্থাৎ বছরের শেষ প্রান্তিকে গিয়ে এই ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। সেই অর্থের যোগানও অর্থ বিভাগকে দিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্র নির্মাণে সরকার কী নীতি অনুসরণ করবে সেটি একান্ত সরকারের বিষয়। কেউ চাইলেই দেশে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে কেন্দ্র নির্মাণের আগে অবশ্যই তাকে বিদ্যুত বিক্রির জন্য পিডিবির সঙ্গে ক্রয় চুক্তির পাশাপাশি বিদ্যুত বিভাগের সঙ্গে নির্মাণ চুক্তি করতে হয়। এখন সরকার তেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নিরুৎসাহিত করতে চাইলে এজন্য শুল্ক আরোপ করার প্রয়োজনীয়তা নেই। জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান বলেন, তেলের দাম যেহেতু পাসথ্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেজন্য এই শুল্ক আরোপে আয় বাড়বে না। এটি নিয়ে আবার বিদ্যুত উৎপাদনে ভর্তুকি হিসেবে দিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিদ্যুত বিভাগ থেকে অর্থ বিভাগে একটি চিঠি দেয়া হবে। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে এটি প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করবে বিদ্যুত বিভাগ। তিনি বলেন, আমরা মোটামুটি যে হিসেব করেছি তাতে এই শুল্ক পরিশোধে চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হবে। আমরা আশা করবো, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানোর স্বার্থে সরকার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। কারণ উৎপাদন খরচ কম থাকলে ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুত পাবেন।