বাংলাদেশে কয়লা, তেল ও এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি বাড়ছে। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী হলেও পরিবেশগত ঝুঁকি বেশি। আবার তেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে। এলএনজি অপেক্ষাকৃত পরিবেশবান্ধব হলেও ব্যয়বহুল।সরকারের বর্তমান নীতি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে এই তিন জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানি আরও বাড়বে। সক্ষমতার অতিরিক্ত এই সম্প্রসারণের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বোঝা বড় হচ্ছে। এটি দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আর্থিক অবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে বিদ্যুতের দাম অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হারে বাড়তে পারে।আন্তর্জাতিক সংস্থা ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকনোমিকস এন্ড ফিনান্সিয়াল এনালাইসিস’র (আইইইএফএ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য এবং বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ‘বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ফিনান্সিয়াল রেজাল্টস ২০২০-২১’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ভবিষ্যতের আর্থিক ক্ষতি ও হুমকি কমানোর জন্য বর্তমানে যে ইন্ট্রিগ্রেটেড এনার্জি এন্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান (আইইপিএমপি) প্রস্তুত করা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ও আর্থিকভাবে টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে।নতুন আইইপিএমপিতে ২০৩০ সালের মধ্যে তখনকার চাহিদার ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ১০ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের বাকি দেশগুলোর মত বাংলাদেশও যদি স্বল্পমূল্যে নবায়নযোগ্য শক্তির সুফল ভোগ করতে চায় তবে এরকম উচ্চাকাঙ্ক্ষী বায়ুকল ও সোলার টার্গেট নতুন আইইপিএমপিতে গ্রহণ করতে হবে।প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানিকৃত কয়লা, এলএনজি, তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিদ্যুৎ ক্রয়ের ক্রমাগত ব্যয়বৃদ্ধির কারণে পিডিবি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। গত জানুয়ারিতে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়। দাম বাড়ানো না হলে প্রতিষ্ঠানটির ৩২৫ বিলিয়ন টাকা (৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঘাটতি দেখা দিবে বলে পিডিবি ক্রমাগত জানিয়ে আসছে।পিডিবির এই প্রস্তাবের ফলে উল্লেখযোগ্য হারে দাম বৃদ্ধি করার জন্য চাপ ক্রমাগত আসতেই থাকবে। অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি, ক্রমবর্ধমান ক্যাপাসিটি পেমেন্ট এবং অস্থিতিশীল মূল্যের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণে পিডিবির আর্থিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। বর্তমান বাস্তবতায় ধারণা করা যায় যে পিডিবির অপারেটিং লস বাড়তে থাকার কারণে সরকারি ভর্তুকি এবং ট্যারিফ বৃদ্ধি করার প্রয়োজনও বাড়তেই থাকবে।ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট (আইপিপি) থেকে আগের বছরের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার কারণে পিডিবির অপারেটিং লস ২০২০-২১ অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই বিশাল পরিচালন লোকসানের ফলে সরকারকে এই লোকসান মিটিয়ে পিডিবিকে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচাতে গত বছর ৭৪ বিলিয়ন টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ বিলিয়ন টাকার (১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) রেকর্ড পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়েছে।প্রথমবারের মত এখন পিডিবির মোট অপারেটিং খরচের ৫০ শতাংশের চেয়েও বেশি আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনার পেছনে ব্যয় হচ্ছে। আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনার খরচ বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনার খরচ বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৬ টাকা। আগের বছর এই কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৬দশমিক ৩ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত অর্থবছরে ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি দাম বেড়েছে। এর মূল কারণ হল এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে ব্যয়কৃত গতানুগতিক ক্যাপাসিটি পেমেন্ট যা পাওয়ার ট্রান্সমিশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার নির্মাণের সময় কেন্দ্রটি অচল অবস্থায় পড়ে থাকা সত্ত্বেও ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে পিডিবি প্রতিমাসে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টাকা (১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিয়ে আসছে।আরও বড় বড় কয়লাভিত্তিক আইপিপি নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে এবং এলএনজি-ভিত্তিক আইপিপি’র পরিকল্পনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ পিডিবির আইপিপি খরচ ভবিষ্যতেও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তেই থাকবে।পিডিবির ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১২ হাজার ৯৬৭ মেগাওয়াটের পাওয়ার ক্যাপাসিটি নির্মাণাধীন রয়েছে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ নাগাদ ১৯ হাজার ৬৫১ মেগাওয়াট যোগ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে পুরনো ক্যাপাসিটির মাত্র ৩ হাজার ৯৯০ মেগাওয়াট অপসারণ করার পরিকল্পনা পিডিবির রয়েছে।তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৬০০ মেগাওয়াট এবং রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিলম্বিত অবস্থায় পরে থাকা রামপাল কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অত্যধিক বাজেটের মাতারবাড়ি ১ কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও এর সঙ্গে যুক্ত হবে। এর পাশাপাশি, ভারতের ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত আদানি পাওয়ারের মালিকানাধীন গোড্ডা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে যা ২০২২ সালে চালু হবার কথা।এছাড়া ২০২৫ সাল নাগাদ এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুতের বিশাল ক্যাপাসিটি চালু হওয়ার কথা এবং আরও অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে এলএনজির অস্থিতিশীল বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়বে। ২০২১ সালে এলএনজির মূল্যের রেকর্ড পরিমাণ ঊর্ধ্বগতি ছিল। প্রথমবারের মতো প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিটের দাম ৫০ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় অধিকতর এই বৃহৎ বিদ্যুৎ সংযোজনের ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ সার্বিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার আরও কমে যাবে। এমনকি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও সার্বিকভাবে বৈদ্যুতিক ক্যাপাসিটির মাত্র ৩৮ শতাংশ ব্যবহার হবে। আইপিপিসহ নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এত কম ব্যবহার হওয়ার মানে হল এগুলো নিষ্ক্রিয় থাকাকালে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বেড়ে যাওয়া এবং পিডিবির খরচ ও লোকসান বৃদ্ধি পাওয়া।যদি আইইপিএমপি জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মাতারবাড়ি ২ এর মত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর বেশি নজর দেয়, তাহলে জাইকা প্রতিশ্রুত লো কার্বন এনার্জি সিস্টেমে রূপান্তর সম্ভব হবে না।যদি জাইকা আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক পাওয়ার ক্যাপাসিটি ক্রমাগত প্রসারণের আহ্বান জানায়, তাহলে বরং অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি, ক্রমবর্ধমান ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, বিপিডিবির ক্রমবর্ধমান অপারেটিং লস এবং ফলস্বরূপ বাড়তে থাকা সরকারি ভর্তুকি ও পাওয়ার ট্যারিফের সমস্যা আরও বাড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।