রিপন হোসেন সাজু নেহালপুর,(যশোর): বৃষ্টির কারণে যশোরের মনিরামপুর ও অভয়নগর উপজেলার ৩০টিরও বেশি গ্রামে পানি ঢুকেছে। এসব গ্রামের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে ভবদহ অঞ্চলের বিলগুলো ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। নদী দিয়ে ঠিকমতো পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধ এসব বাড়ির লোকজন পরিবার নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন।
যশোরের মনিরামপুর ও অভয়নগর, কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এই এলাকার পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ-নদী দিয়ে। পলি পড়ে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে এসব নদী দিয়ে এখন ঠিকমতো পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এ কারণে বৃষ্টির পানি আটকা পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টি ১ থেকে ১০ মিলিমিটার হলে সেটিকে হালকা বৃষ্টি বলা হয়। আর ১১ থেকে ২২ মিলিমিটারের মধ্যে বৃষ্টি হলে তা মাঝারি ধরনের বৃষ্টি। মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি বলা হয় পরিমাণ ২৩ থেকে ৪৩ মিলিমিটার হলে। আর ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটারের বৃষ্টি হচ্ছে ভারী বৃষ্টি। যদি ৮৮ মিলিমিটারের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়, তবে তা অতি ভারী বৃষ্টি হিসেবে ধরা হয়।
যশোরের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমানঘাঁটির আবহাওয়া বিভাগ জানায়, যশোরে জুন মাসে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাত ধরা হয় ২৯৮ দশমিক ৭ মিলিমিটার এবং জুলাই মাসে ৩০৪ দশমিক ১০ মিলিমিটার। গত জুন মাসে যশোরে ২৯৯ মিলিমিটার এবং চলতি জুলাই মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত ৫১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এসময় হাল্কা থেকে মাঝারি আবার কথনও ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে ভবদহ অঞ্চলের ৫২টি বিল প্লাবিত হয়েছে। বিল উপচে পানি ঢুকতে শুরু করেছে আশপাশের গ্রামগুলোতে।
মনিরামপুর উপজেলার লখাইডাঙ্গা গ্রামের গৃহবধূ জয়শ্রী মণ্ডল(৪২) বলেন, ‘উঠোনে প্রায় হাঁটু জল। আর একটু জল বাড়লে ঘরে জল উঠে যাবে। ঘরে জল উঠলে রাস্তায় উঠা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
মনিরামপুর উপজেলার সুজাতপুর গ্রামের সাধন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমার বাড়ির উঠোনে জল। প্রতিদিন জল বাড়ছে। আর একটু বৃষ্টি হলে বাড়িঘর ছাড়তে হবে।’
বাজেকুলটিয়া গ্রামের গৃববধূ লাভলী বিশ্বাস বলেন, ‘এবার আগেই বাড়িতে জল এসেছে। উপরের জলের চাপে প্রতিদিন জল বাড়ছে। টিউবওয়েল, বাথরুম জলের তলে চলে গেছে। থাকার ঘরে জল উঠার মতো অবস্থা হয়েছে। খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’
অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের দিলিপ বিশ্বাসের(৪০) বাড়ির উঠানে হাঁটু পানি। উঠানের পানিতে তিনি মাছ ধরার চাঁই পাতছিলেন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির সঙ্গে উপরের দিকের জল চাপ দেওয়ায় জল বেড়েই চলেছে। উঠোনে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছি। ঘর থেকে সাঁকো দিয়ে বের হচ্ছি। জল আর একটু বাড়লে ঘরে ঢুকবে।’
একই গ্রামের সুভাষ বিশ্বাস(৫২) বলেন, ‘খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। যেভাবে জল বাড়ছে, তাতে এবারও জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নেবে।’
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালীর বাড়ির উঠোনে হাঁটু পানি। পানি ছুঁইছুঁই করছে তাঁর ঘরের বারান্দায়। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির জল জমে ভবদহ এলাকা ডুবতে শুরু করেছে। এলাকার ৩০টিরও বেশি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অনেকের বাড়িতে জল। অনেক শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জল ঢুকেছে।
তিনি বলেন, ‘ভবদহের ২১-ভেন্ট স্লুইসগেটের মধ্যে মাত্র ছয়টি গেট খোলা হয়েছে। গেট দিয়ে বেশি জল নামছে। সবগুলো গেট খুলে দিলে আরও বেশি জল নামতো। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড সব গেট খুলছে না। এলাকার বিলে টিআরএম-টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট (জোয়ারাধার) চালু না করলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি নেই।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড, যশোরের কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘নদীতে জোয়ারের সময় ভবদহ স্লুইসগেটের ২১-ভেন্টের উপর চারটি বড় ও ১৫টি ছোট বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে বের করে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ভাটির সময় ছয়টি গেট খুলে দেওয়া হচ্ছে। গেটগুলো দিয়ে প্রচুর পানি বের হচ্ছে। এতে এলাকার পানি দ্রুত সরে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘ভবদহ এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য সেনাবাহিনী আগামী মাসে সেনাবাহিনী ছয়টি নদীর ৮১ দশমিক ৫ কিলোমিটার খননকাজ শুরু করবে। এ ছাড়া আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। দুই-এক মাসের মধ্যে আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের কাজ শুরু হবে।’