৮৪২ টাকা নির্ধারণ
হলেও বিক্রি ৯৫০

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম এলপি গ্যাস। আর এই এলপি গ্যাস নিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এক কথায় এলপি গ্যাস নিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে তেলেসমাতি করা হচ্ছে বলেও অনেকের অভিযোগ।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি গ্যাসের দাম বাড়ালে সাথে সাথেই ব্যবসায়ীরা দাম হাকিয়ে দেয়। কিন্তু বিইআরসি দাম কমানোর ঘোষণা দিলে সেটি তৃণমুলে এসে পৌঁছে না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচার করা হলেও সেটিকে আমলে নেয়না ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে গ্যাস কোম্পানীগুলো অনেকটা গোলেমালে করেই কাটিয়ে দিতে চায় সময়। যেমনটি হচ্ছে চলতি মাসে।
পয়লা জুন থেকে এলপি গ্যাসের খুচরা মূল্য সিলিন্ডার প্রতি ৮৪২ টাকা নির্ধারণ করা হলেও খুলনার কোথাও এটি বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু খুলনায়ই নয়, বরং দেশের সব জায়গায়ই ১২ কেজি ওজনের সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে সাড়ে নয়শ’ টাকার উপরে। যেটি দেখার জন্য নিয়োজিত রয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু তারাও এ ক্ষেত্রে অনেকটা অসহায়। ওই দপ্তরের সহকারী পরিচালক হিসেবে খুলনায় কর্মরত শিকদার শাহীনুর আলম বলেন, কোম্পানীগুলোই বেশি দামে গ্যাস বিক্রি করছে। অভিযানে গেলে ব্যবসায়ীরা ক্রয়মূল্য বেশি দেখায়। আর কেনা দাম যেখানে বেশি সেখানে সামান্য লাভ নিয়ে তারা বিক্রি করলে তাদের কিছু করার থাকে না। এজন্য কোম্পানীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে। সুতরাং মাঠ পর্যায়ে তাদের এ ব্যাপারে কিছুই করার নেই।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের যেখানে এমন অবস্থা সেখানে সাধারণ মানুষ যতোই আন্দোলন-সংগ্রাম করুক কোন কাজে আসবে না এমনটিও দাবি করেছেন কেউ কেউ। তার পরেও জনগণকে সোচ্চার হতে হবে বলে জানিয়েছেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে রাজপথে থাকা অনেক ব্যক্তি। এদেরই একজন সরদার রুহিন হোসেন প্রিন্স। যিনি জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং এক সময়ের তুখর ছাত্রনেতা। কথা বলেন সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে। তিনি এ প্রতিবেদককে বললেন, নিয়মানুযায়ী দাম নির্ধারিত না হওযায় এতোদিন ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামত দাম নির্ধারণ করে বাজারে বিক্রি করছিল। ১২ কেজি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ৮৪২ টাকা নির্ধারিত হলেও সেটি না মেনে কোম্পানিগুলো অপরাধ করছে। এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাজারে নির্ধারিত দামে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন,সারা বছর সাশ্রয়ী ও নির্ধারিত মূল্যে নিরাপদ সিলিন্ডার মানুষের কাছে পৌঁছতে বিদেশ থেকে এলপিজি আমদানি ও ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভরশীল থেকে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না। এজন্য দেশের স্থল ও সমুদ্রভাগের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে সিলিন্ডার গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ করতে হবে। একইসাথে তিনি সরকারিভাবে উৎপাদিত সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাস নির্ধারিত ৫৯১ টাকায় দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরবরাহের দাবি করেন।
এদিকে, বিইআরসির একটি সূত্র জানায়, আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আবারো একটি গণশুনানী হতে পারে। ওই গণশুনানীর মাধ্যমেই এলপি গ্যাসের মূল্য পুন:নির্ধারণ করা হবে। এ বিষয়ে সরদার রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ওই গণশুনানীর আয়োজন করা হয়েছে কোম্পানীগুলোর চাপে। অর্থাৎ কোম্পানীর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বিইআরসি তথাকথিত গণশুনানীর নামে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। অথচ চলতি মাসে গ্যাসের যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সেটি দেশের কোথাও মানা হয়নি। গণশুনানী করতে হলে আগে ব্যবসায়ীদের মুচলেকা দিতে হবে যে, তারা সিদ্ধান্ত মানবে। তা’ না হলে কথিত গণশুনানী করে একেকবার দাম নির্ধারণ করে ক্রেতাদের গলাকাটা হবে সেটি দেশের মানুষ মেনে নেবে না।
যদিও এ ব্যাপারে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য মো: মকবুল-এ-ইলাহী চৌধুরী বলেন, গণশুনানীর মাধ্যমে সকলের মতামতের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণের যে প্রথা রয়েছে সেখানে সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মতামত দেয়া উচিত। কোন পক্ষকে মাঠ ছেড়ে দিয়ে কেউ যদি গণশুনানীতে অংশগ্রহণ না করেন তাহলে সেটি হবে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। এজন্য আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে যে গণশুনানীর কথা রয়েছে সেখানে সকলের অংশগ্রহণ ও যৌক্তিক মতামত তুলে ধরা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
অবশ্য এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য বিইআরসি থেকে জেলা প্রশাসকদের জানিয়ে দেয়া হয়। যেটি জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে স্থানীয় টাস্কফোর্স এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, ব্যবসায়ীরাই ওইসব সরকারি সংস্থাকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চড়া মূল্যে গ্যাসের দাম নিচ্ছে। জুন মাস শেষ হতে চললেও খুলনার কোথাও এ পর্যন্ত অধিক মূল্যে গ্যাস বিক্রির কারণে কোন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা জরিমানা আদায় করা হয়েছে এমন নজির নেই।
বরং এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শিকদার শাহীনুর আলম বলেন, কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সতর্ক করা হয়েছে যাতে সরকার নির্ধারিত মূল্যে এলপি গ্যাস বিক্রি করা হয়। যেহেতু খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বেশি দামে কিনছে সেহেতু তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছেনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোম্পানী থেকেই যাতে সরকার নির্ধারিত মূল্য নেয়া হয় সেটি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এড. মো: বাবুল হাওলাদার বলেন, গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করে দিলেই শুধু হবে না, বরং মাঠ পর্যায়ে এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সেদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে কঠোর নজরদারি রাখা প্রয়োজন। আর যেটি দরকার সেটি হচ্ছে জনগনের সচেতনতা। কিন্তু নজগনের এখন কথা বলারতো অধিকার নেই, সুতরাং সচেতন হলেই বা কি করার আছে এমন পাল্টা প্রশ্নও তোলেন এই নাগরিক নেতা।
অপরদিকে, গ্যাস ব্যবসায়ীদের সংগঠন খুলনা এল,পি গ্যাস ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি শেখ মো: তোবারেক হোসেন তপু বলেন, খুচরা পর্যায়ে এলপি গ্যাস বিক্রির ক্ষেত্রে তারা রয়েছেন উভয় সংকটে। একদিকে পরিবেশকদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হয়, অপরদিকে রয়েছে সরকার নির্ধারিত মূল্য। এর বাইরেও বর্তমানে তারা যে সমস্যায় রয়েছেন সেটি হচ্ছে লকডাউনের নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানি। অনেক সময় গ্যাস বহনকারী যানবাহনও বন্ধ করে দেয়া হয়। অতি প্রয়োজনীয় একটি দ্রব্য হলেও অনেক স্থানে গ্যাসের দোকান খুলতেও বাধা দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে তাদের এ সংকট মোকাবেলা করার জন্যই এখন তারা আন্দোলনমুখী।