/ মাহাবুব ব্রাদার্সের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলো কেডিএ, অনিশ্চয়তায় শিপইয়ার্ড সড়ক প্রকল্প

মাহাবুব ব্রাদার্সের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলো কেডিএ, অনিশ্চয়তায় শিপইয়ার্ড সড়ক প্রকল্প

প্রকল্পের ৭০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি# ৩.৭৫ কিলোমিটার সড়ক, লবণচরা সেতু, মতিয়াখালী স্লুইস গেটের কাজ মাঝপথে বন্ধ # কবে শুরু হবে কেউ জানে না

এ এইচ হিমালয় : নগরীর রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে খানজাহান আলী (রূপসা) সেতু পর্যন্ত শিপইয়ার্ড সড়কটি বেহাল প্রায় একযুগ ধরে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্স সড়কটির সংস্কার কাজ করছিল। দীর্ঘদিন ধরে কাজটি ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ ঘটানো, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করায় গত ৭ আগস্ট মাহাবুব ব্রাদার্সের সঙ্গে কাজের চুক্তি বাতিল করেছে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। এতে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক সংস্কার, লবণচরা সেতু ও মতিয়াখালী স্লুইচগেটের নির্মাণ কাজ। কবে এই কাজ শুরু হবে কেউ বলতে পারছে না। ফলে ওই এলাকার মানুষের দুর্ভোগ আরও দীর্ঘ হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।

কেডিএ থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আতাউর রহমান লিমিটেড অ্যান্ড মাহাবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড (জয়েন্ট ভেঞ্চার) কে কার্যাদেশ দেয় কেডিএ। ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তাদের ৩ দশমিক ৭৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটি ৪ লেনে প্রশস্ত করে পুনঃনির্মাণ, দুই পাশে ড্রেন ও ফুটপাত, সড়কের মাঝে দশমিক ৯২ মিটার ডিভাইডার নির্মাণ, লবণচরায় ৬৬ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ এবং মতিয়াখালীতে স্লুইসগেট ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য কথা ছিল। ইতোমধ্যে তারা ৭০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। কিন্তু অর্ধেকের বেশি কাজও শেষ হয়নি।

বর্তমানে সড়কের বেজ টাইপ-২ (বর্তমান সড়কের ওপর পাথরের স্তর), বেজ টাইপ-১, ৪ ইঞ্চি বিটুমিনের কার্পেটিং (পিচের স্তর), তারওপর সিলকোর্ট (বিটুমিনের আরেকটি স্তর) দেওয়া বাকি রয়েছে। এসব কাজের ব্যয় বেশি এবং মুনাফা কম। এর তুলনায় সড়কে মাটির নিচের বালু এবং ইটের টুকরা স্থাপনের কাজ লাভজনক, সহজ ও মুনাফা বেশি। লাভজনক অংশটুকু করে মুনাফা টাকা তুলে নিয়েছে মাহাবুব ব্রাদার্স। তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করায় বাকি অংশ অন্য কোনো ঠিকাদার করতে রাজি হবে না। ফলে সহসা সড়কের কাজ শুরুর কোনো আশা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।

একই অবস্থা লবণচরা সেতুর। ৬৬ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুর পাইলিং শেষ করেছে ঠিকাদার। ১০টি গার্ডারের মধ্যে মাত্র একটির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৯টি বাকি রয়েছে। এখানেও মাটির নিচে লাভজনক কাজটুকু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মতিয়াখালীতে দুই স্তরের স্লুইচগেটের মধ্যে এক স্তর শেষ করেছে মাহাবুব ব্রাদার্স। অন্য স্তর স্থাপন না করায় জোয়ারের সময় ওই গেট দিয়ে শহরের ভেতরে পানি প্রবেশ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সড়কটি নিয়ে প্রায় একযুগ ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। কারণ ২০১৩ সাল পর্যন্ত খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০১৩ সালের ৭ মে সড়কটি ৪ লেনে উন্নীত করণের জন্য একনেকে প্রকল্প অনুমোদন করায় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। প্রকল্প ব্যয় ছিল ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এরপর থেকে সড়কটি কেডিএর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যার কারণে কেসিসি সড়কটি সংস্কার বন্ধ করে দেয়। নানা জটিলতায় নির্ধারিত সময়ের ৯ বছর পর কাজ শুরু করে তারা।

সূত্রটি জানায়, ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি সড়কের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্স। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। ফলে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। ব্যয় বেড়ে দাড়ায় ২৫৯ কোটি টাকা।

এলাকাবাসী জানান, ঠিকাদার কাজ শুরুর পর তাদের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। সড়কের দুই পাশে খনন করে প্রায় একবছর ধরে ফেলে রেখেছে। তখন দুই পাশের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে যায়। নির্মাণ কাজে গতি ছিল না কখনোই। এবড়ো-থেবড়ো সড়কে চলাচলে দুর্ভোগও তাই কমছে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, সড়ক সংস্কারের জন্য বিভিন্ন স্থানে ইটের খোয়া ফেলা হয়েছে। বৃষ্টিতে খোয়া সরে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত তৈরি হচ্ছে। বৃষ্টিতে পানিতে পরিপূর্ণ সেই গর্তে পড়ে উল্টে যাচ্ছে যানবাহনের চাকা। রূপসা সেতুর দুই সংযোগ সড়কের অবস্থা চষাখেতের চাইতেও খারাপ।

দেখা গেছে, সড়কের পাশে রূপসা বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়, দাদা ম্যাচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শিপইয়ার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আল আমিন একাডেমি, লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাজী মালেক দাখিল মাদ্রাসা, ইব্রাহিম ক্যাডেট মাদ্রাসা, সরকারি সালাউদ্দিন ইউসুফ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাজী মালেক কলেজ রয়েছে।

রূপসা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অমিয় কান্তি পাল বলেন, ভাঙাচোরা সড়কের কারণে সবাইকে আধাঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে রওনা দিতে হয়। বাড়ি ফিরতেও দেরি হয়। বছরে শত শত কর্মঘণ্টা এই সড়কেই নষ্ট হচ্ছে।

সড়কের লবণচরা এলাকা অবস্থিত বান্দা বাজারে প্রায় ৪৫০টি দোকান রয়েছে। এই বাজারের ব্যবসায়ীদের সংগঠনের নাম লবণচরা বাজার ব্যবসায়ী সমিতি। সংগঠনের সভাপতি এনামুল কবির বলেন, ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে পণ্য আনা যায় না। দূরের কেউ আমাদের কাছ থেকে পণ্য কেনেও না। শুধুমাত্র রাস্তার কারণে অসংখ্য ব্যবসায়ী পথে বসে গেছে। প্রথম দিকে রাস্তার দু’পাশে খাল কেটে ফেলে রেখেছিল দেড়বছর। তখনই কেনাবেচা বন্ধ হয়ে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। আমি নিজেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম।
তিনি জানান, বান্দাবাজারসহ শিপইয়ার্ড সড়কের দুই পাশের পাঁচশ’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বান্দা বাজারসহ সব দোকান মিলিয়ে বছরে গড়ে ৫০ কোটি টাকার কেনাবেচা হতো। সড়কের কারণে এখন এক কোটিও হয় না।

এ ব্যাপারে খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মো. আরমান হোসেন জানান, সড়কের ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রেখেছিল ঠিকাদার। সাবেক গৃহায়ণ উপদেষ্টা, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা একাধিকবার ঠিকাদারকে দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশ দিলেও তারা শোনেনি। এজন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তাদের জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাকি কাজের জন্য দ্রুত দরপত্র আহ্বান করা হবে। ২০১৮ সালের রেটে কেউ অংশ নিতে না চাইলে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব পাঠানো হবে।