ভেঙে ফেলা হচ্ছে জিয়া (পাবলিক) হল
* নির্মাণ শুরু ১৯৭৯ সালে, ১৯৯২ তে উদ্বোধন
২০১৯ সালে পরিত্যক্ত, ২০২২ সালে অপসারণ
* বহুতল সিটি সেন্টার নির্মাণ করবে কেসিসি
* ১৮ বছরে কেন পরিত্যক্ত কারণ খোঁজা হয়নি

এ এইচ হিমালয়নব্বই দশকের নান্দনিক স্থাপনা ছিলো খুলনার জিয়া (পাবলিক) হল ভবন। দ্বিতল গ্যালারি বিশিষ্ট মিলনায়তন, আধুনিক সুবিধা সংবলিত এই ভবনই ছিলো সভা-সমাবেশ, নাটকসহ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত বিশাল কমপ্লেক্সটি খুলনা নগরীর ট্রেডমার্ক।
মাত্র ১৮ বছর ব্যবহারের পরই ২০১০ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই হল। এরপর ১২ বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে জিয়া হল কমপ্লেক্স। সম্প্রতি ভবনটি ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে।
কেসিসি থেকে জানা গেছে, জিয়া হলের এই স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এই প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। মূলত নতুন ভবনের কাজ এগিয়ে নিতেই পুরাতন স্থাপনাটি নিলাম তোলা হয়েছে।
তবে বিপুল টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিশাল ভবনটি কেন ১৮ বছরে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লো তার কারণ অনুসন্ধান করেনি কেসিসি। কোনো তদন্তও হয়নি। জড়িত কারও শাস্তিও হয়নি। বন্ধ, পরিত্যক্ত, অপসারণ এবং নতুন সিটি সেন্টারের ডামাডোলে মূল প্রশ্নটি এড়িয়ে গেছেন সবাই।
বিভিন্ন সরকার কমপ্লেক্সটি কখনো পাবলিক হল, কখনো জিয়া হল নামকরণ করেন। অনেকের কাছে এটি জিয়া হল নামেই বেশি পরিচিত।
॥ ১৩ বছরে চলেছে নির্মাণ কাজ ॥
কেসিসির পুরাতন নথি ঘেটে দেখা গেছে, বর্তমান হল কমপ্লেক্সটি নির্মাণ হয়েছে কয়েকটি ধাপে। ১৯৭৮ সালের ১২ জানুয়ারি জিয়া হলের জন্য জমি হস্তান্তর করে কেডিএ। সেখানে পৌরসভারও কিছু জমি ছিলো। মোট ১ দশমিক ৭২১৭ একর জমির ওপর হলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। তখন খুলনা পৌর সভার চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যাডভোকেট এনায়েত আলী। পরের দুই বছর ২৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে ২৯৪টি পাইল স্থাপন করা হয়। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর হলের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ৮ বছর কাজ বন্ধ ছিলো।
১৯৮৯ সালে তৎকালীন মেয়র কাজী আমিনুল হক পুনরায় হলের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ওই বছর স্থাপন করা হয় ২০৪টি পাইল। এতে ব্যয় হয় ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরের বছর আবার কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯১ সালে কেসিসির মেয়রের দায়িত্ব পান তৈয়েবুর রহমান। তার সময় জিলা হলের মূল সুপার স্টাকচারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বাইরে থেকে দৃশ্যমান বর্তমান স্থাপনাটি নির্মাণের জন্য ব্যয় হয় ১ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কাজটি করেছিল তমা কনস্ট্রাকশান নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির নামে মেয়রের এক নিকটআত্মীয় কাজটি করেছিলেন বলে ওই সময়কার কয়েকজন কর্মকর্তারা পূর্বাঞ্চলকে জানিয়েছেন।
১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এই হলের উদ্বোধন করেন। তখন এর নামকরণ করা হয় ‘জিয়া হল’। ১৯৯২ সালের ২৯ নভেম্বর মূল ভবনের কাজ শেষ হয়। এরপর অডিটোরিয়ামের চেয়ার, বিদ্যুৎ সংযোগসহ আরও কাজ হয়েছে।
॥ জিয়া হলে যে সব সুবিধা ছিলো ॥
দুই ভাগে বিভক্ত জিয়া হলের মূল আকর্ষণ ছিলো দুই তলা গ্যালারিসহ বিশাল মিলনায়তন। মূল মিলনায়তনে ১ হাজার ৬৫টি আসন ছিলো। মঞ্চে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংযোজন করা হয়েছিলো। অন্যদিকে ছোট সভার জন্য ছিলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১৯০টি আসনের পৃথক সেমিনার কক্ষ। এছাড়া দুই হাজার ৫০০ বর্গ ফুট আকারের দুটি লাউঞ্জ, মঞ্চসংলগ্ন আসবাবপত্র কক্ষ, তিনটি মহরতকক্ষ, একটি বিশ্রামকক্ষ, দুটি লেডিস কর্নার, একটি নামাজ ঘর, মেকআপকক্ষ, অফিসসহ নানা সুবিধা ছিলো এই হলে।
॥ পরিত্যক্ত ঘোষণার পরিক্রমা ॥
উদ্বোধনের পর থেকে জিয়া হলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে খুলনার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। নগরীর সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা হতো এই কমপ্লেক্সে। ২০০৩ সালে কয়েক দফা লাউঞ্জের পলেস্তারা ও ঢালাই খসে পড়ে। ২০০৭ সাল থেকেই মূল ভবনের পলেস্তারা ও ঢালাই খসে পড়তে শুরু করে।
কেসিসির পূর্ত বিভাগ থেকে জানা গেছে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জিয়া হল সংস্কার ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সংযোজন করতে অর্থ বরাদ্দ দেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল।
২০০৮ সালে জিয়া হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সংযোজন এবং সংস্কার করতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষকদের একটি সমীক্ষা চালানোর অনুরোধ জানায় কেসিসি। কুয়েটের টিম পরিদর্শন শেষে তারা জানান, ভবনটি আর মেরামত উপযোগী নেই। ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দেন তারা।
২০০৯ সালে জিয়া হলের ভেতরেই খুলনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি প্রকৌশলী ও স্থপতিদের নিয়ে সভা করেন তৎকালীন মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। তারাও ভবনটি সংস্কার উপযোগী নেই উল্লেখ করে ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণের পরামর্শ দেন। পরে আবার পলেস্তারা খসে পড়লে মূল ভবনটি ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০১২ সালে জিলা হল কমপ্লেক্স পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে কেসিসি। এই আবেদনের প্রক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৩ মে বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক এবং কেসিসির প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে কনডেমনেশন কমিটি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ওই কমিটি ২০১৪ সালের ৩ জুন ভবনটির মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেয়। ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। এরও ৪ বছর ২০১৯ সালের ২২ মে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. লোকমান হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় জিয়া হলকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
॥ অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু ॥
কেসিসি থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৬ জুন জিয়া হল নিলামের জন্য দরপত্র আহবান করে কেসিসি। হলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো ৩৮ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩০ টাকা। পরবর্তী ২৪ জুলাই, ৫ আগস্ট, ২৮ অক্টোবর ও ১৮ ডিসেম্বর ৫ দফা নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কোনো ঠিকাদারই নিলামে অংশ নেয়নি।
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর সৌরভ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৪৩ লাখ ৩১ হাজার ২৫০ টাকা দিয়ে জিয়া হলের ভগ্নাবশেষ কিনতে মেয়রের কাছে আবেদন করেন। এই আবেদন সাধারণ সভায় উত্থাপন করা হয়। ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সৌরভ এন্টারপ্রাইজের নিলাম আবেদন অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানের সত্তাধিকারী সমির কুমার দত্ত পূর্বাঞ্চলকে বলেন, আমাদের দুই মাসের মধ্যে ভবন অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ৩০ জন শ্রমিক ভবন ভাঙতে কাজ করছে। মার্চের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।
॥ হবে বহুতল ভবন ॥
জিয়া হলের স্থানে বহুতল ভবনের পরিকল্পনা নেওয়া ২০১২ সালে। সিটি সেন্টার নামে একটি খসড়া নকশা তৈরিও করা হয়। ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর কেসিসির ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়ন (২০০ কোটি) প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়। ওই প্রকল্পে জিয়া হলের স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিলো। কিন্তু পরের বছর মেয়র নির্বাচনে তালুকদার আবদুল খালেক পরাজিত হলে সেই কাজ আর এগোয়নি।
কেসিসির প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবির উল জব্বার বলেন, নগরীর বিভিন্ন প্রকল্পের সমন্বয়ে ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। ওই প্রকল্পে পাবলিক (জিয়া) হলের জন্য ৩১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
কেসিসি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, নিম্নমানের কাজের কারণে দ্রুত স্থাপনাটি নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, ওই স্থানে বহুতল সিটি ট্রেড সেন্টার হবে। সেখানে একাধিক মিলনায়তনসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
॥ অনেক প্রশ্নে উত্তর নেই ॥
কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্থাপনা মাত্র ১৮ বছরে কেন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লো তার কারণ খোঁজার চেষ্টা হয়নি। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের কথা বলা হলেও ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত এনিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত হয়নি। যারা এই কাজ তদারকি করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।
নির্মাণ কাজের সময় দায়িত্বে থাকা মেয়র ও প্রধান প্রকৌশলী মারা গেছেন। সহকারী প্রকৌশলী অবসরে গেছেন আরও আগে। পুরাতন কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি প্রতিবেদক। বর্তমান মেয়রও এনিয়ে তেমন কথা বলতে চান না।
বিশাল কমপ্লেক্সটি যেন অনিয়মের উদাহরণ হিসেবে হারিয়ে গেল। রেখে গেল অসংখ্য মানুষের অযুত সুখ স্মৃতি। হেমন্ত মুখোপধ্যায়ের কালজয়ী সেই গানের মতো…
মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে
স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে।