করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও অধিক মুনাফার আশায় অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানে ধীর গতিতে চাল সরবরাহ করছেন অসাধু মিলমালিকরা। বিভিন্নভাবে তারা সরকারকে সংগ্রহ মূল্য বাড়াতে বলছেন। সরকারও সাফ জানিয়ে দিয়েছে কোন অবস্থায় ধান চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ানো হবে না। এই টানাপোড়েনের মধ্যে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার মিলারদের হুঁশিয়ারি করে বলেছেন, আইনী ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করবেন না। চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহ করুন। না হলে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব। সরকার ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে সরকারীভাবে কৃষকদের কাছ থেকে ৮ লাখ টন ধান এবং মিলারদের কাছ থেকে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল ও দেড় লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বোরো ধান গত ২৬ এপ্রিল থেকে কেনা শুরু হয়েছে। ৭ মে থেকে শুরু হয়েছে চাল সংগ্রহ। ধান-চাল সংগ্রহ শেষ হবে আগামী ৩১ আগস্ট। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা কেজি দরে আতপ চাল কেনা হচ্ছে। এর বিপরীতে সিদ্ধ চাল ও আতপ চাল সংগ্রহের জন্য মিলারদের সঙ্গে ইতোমধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। মোট লক্ষ্যমাত্রার ৯৮ শতাংশ চাল সরবরাহ করবে বলে মিলাররা সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। চুক্তির পর সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর জন্য কয়েক দফা মন্ত্রীকে প্রস্তাব করেছেন মিলাররা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তারা কেজিপ্রতি প্রণোদনা চেয়ে আবেদন করেছেন। একই সঙ্গে তারা সরবরাহ শ্লথ করে রেখেছেন। ১৬ জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সরকারের সংগ্রহ মাত্র এক লাখ মেট্রিক টন ধান এবং চাল ২৯ হাজার মেট্রিক টন। সরকারের হিসাব অনুযায়ী চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহ করলে তাদের লোকসান হবে না। বরং লাভ থাকবে। এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী সাধান চন্দ্র মজুমদার বলেন, সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব আমার কাছে এসেছে। কিন্তু সংগ্রহ মূল্য বাড়ানো কোন অবস্থায় সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সংগ্রহ মূল্য যদি ২ টাকাও বাড়ানো হয়, তা হলে বাজারে চালের দাম কেজিপ্রতি ৮/১০ টাকা করে বেড়ে যাবে। করোনা বিধ্বস্ত দেশে জনগণের ওপর তা’ মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, যারা সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করতে হবে। না হলে তিন বছরের জন্য এই সব মিলকে কালোতালিকাভুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, ধানের দাম বাড়েনি। দাম বাড়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। কিছু মধ্যস্বত্বভোগী যাদের অলস টাকা পড়ে আছে, তারা বেশি লাভের আসায় ধান আটকে রেখেছেন। এছাড়া কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার পরিমাণ দ্বিগুণ করে ৬ মেট্রিক টন করা হয়েছে। এদিকে চুক্তির পরও চলতি মৌসুমে সরকারকে বোরো চাল সরবরাহে গড়িমসি ও দাম বাড়ানোর দাবি তোলা চালকল মালিকদের (মিলার) প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। সরকারী সংগ্রহের ক্ষেত্রে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে মন্ত্রী মিলারদের উদ্দেশে বলেন, আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার রাস্তার দিকে যেতে বাধ্য করবেন না। মিন্টো রোডের সরকারী বাসভবন থেকে বোরো সংগ্রহসহ বিভিন্ন বিষয়ে বরিশাল বিভাগের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে খাদ্যমন্ত্রী এ কথা বলেন। চালকল মালিকদের উদ্দেশে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসুন, প্রতিবছর সমান লাভ হয় না। এবার করোনার সময়ে মানুষকে সেবা করার উপযুক্ত সময়, সেবার মনমানসিকতা নিয়ে আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। আপনারা সরকারের তালিকাভুক্ত। সব সময় সরকার আপনাদের কাছ থেকে চাল ক্রয় করে এবং এবারও আপনারা সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। চালকল মালিকদের চুক্তি অনুযায়ী সঠিক সময়ে চাল দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিচ্ছে। অতএব সেই প্রণোদনার অংশীদারিত্বের সুযোগ আপনারাও নিতে পারবেন। কোনভাবেই সরকারীভাবে চালের মূল্য বৃদ্ধি করা হবে না। মন্ত্রী বলেন, যেহেতু খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতরের সঙ্গে আপনাদের ব্যবসা সবসময় করতে হবে, অতএব লাভ বেশি হলে চাল সরবরাহ করবেন আর লাভ কম হলে চাল সরবরাহ করবেন না-এটা হতে পারে না। আমরা চাই না যে আপনাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং মিলকে কালো তালিকাভুক্ত করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমাদের সেই রাস্তায় যেতে বাধ্য করবেন না। আপনাদের অতি লোভের কারণে যদি সরকারকে আমদানিতে যেতে হয় তাহলে আপনাদের জন্য তা’ সুখকর হবে না। ধান-চাল কেনায় কেউ অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, চাল সরবরাহের সময় খাদ্য গুদামের নাম, তারিখ এবং কোন খাতে (খাদ্যবান্ধব, ওএমএস, টিআর, কাবিখা) এটা স্পষ্ট স্টেনসিলের মাধ্যমে অমোচনীয় কালি দিয়ে লিখতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা কোনভাবেই সংগ্রহ মূল্য বাড়াবে না। অর্থনীতিবিদ এবং খাদ্যনীতিবিষয়ক সংস্থাগুলোও মনে করছে, এই সময়ে চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ালে কৃষক তো লাভবান হবেনই না, উল্টো বাজারে অযৌক্তিকভাবে চালের দাম বেড়ে যাবে। আমরা আশা করবো, সরকার মিলারদের সাথে বোঝাপড়া করে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল করতে সক্ষম হবেন।