রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো শুরু হতে পারে চলতি বছরই। আসছে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আশা প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। চীনের মধ্যস্থতায় গত মঙ্গলবার মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এ আশার কথা জানান। তার ভাষায়, তিনি ‘সতর্কভাবে আশাবাদী’। তবে অন্য সময়ের চেয়ে মঙ্গলবারের বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে মিয়ানমারকে অনেক বেশি ইতিবাচক মনে হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, বৈঠকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় থাকা চীনও বাংলাদেশের যুক্তিগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। এ কারণে তিনি রোডম্যাপ অনুযায়ী বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) কম সংখ্যায় হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আশাবাদী। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা থেকে সাড়ে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষে অংশ নেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। মিয়ানমারের পক্ষে সে দেশের একজন উপমন্ত্রী এবং চীনের পক্ষে একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট অংশ নেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব জানান, বৈঠকে প্রত্যাবাসন রোডম্যাপ বাস্তবায়নে ছয়টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলো ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়িত হবে। সচিব বলেন, দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত এ বৈঠক অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। বৈঠকে মূল আলোচনার বিষয় ছিল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। এতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট দিন দিন জটিল হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পর নিরাপদ বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি নিয়ে আলোচনা হয়। মিয়ানমার রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম তুলে ধরে। এরপর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়। পররাষ্ট্র সচিব জানান, রোডম্যাপ অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর রূপরেখা তৈরির জন্য বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে-১. আসছে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠকেও চীন মধ্যস্থতা করবে। আগে ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের মহাপরিচালক এবং মিয়ানমার ও চীনের রাষ্ট্রদূতরা অংশ নিতেন। আগামী ওয়ার্কিং গ্রুপটি আরও বিস্তৃত পরিসরে হবে। তিন দেশেরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালকরা অংশ নেবেন। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিতব্য এই বৈঠকেই প্রত্যাবাসনের মূল রূপরেখা নির্ধারণ করা হবে। ২. ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের পর সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনার জন্য তিন দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠক হবে। বৈঠকটি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে কিংবা সশরীরে হতে পারে। বৈঠকের স্থান হতে পারে ঢাকা বা কক্সবাজার। তবে বৈঠকটি বেইজিংয়ে করার আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। বৈঠকের স্থান পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত করা হবে। ৩. সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর মার্চে তিন দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হবে। তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এতে অংশ নেবেন। এই বৈঠক থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করা হতে পারে। ৪. এসব বৈঠকের পর আবারও মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসবে। তাদের রোহিঙ্গা শিবিরে নিয়ে যাওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের বক্তব্য হচ্ছে, আগে দু’বার মিয়ানমার প্রতিনিধি দল এলেও তাদের সঠিকভাবে রোহিঙ্গাদের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। এমন একটি গ্রুপের কাছে নেওয়া হয়েছে যারা মিয়ানমারে ফেরার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা এবার উপযুক্ত রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলতে চায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপযুক্তদের সঙ্গে আলাপের বিষয়টি নিশ্চিত করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ৫. বৈঠকে পাইলট ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গ্রাম বা অঞ্চল ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে পরিচিত এমন ছোট ছোট দলকে দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তাব দেওয়া হয়। নিজেদের মধ্যে পরিচিত গ্রুপ হলে প্রত্যাবাসনে বেশি আগ্রহী হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়। তবে মিয়ানমার বলেছে, যে ৪২ হাজার রোহিঙ্গা তারা যাচাই-বাছাই করেছেন, তাদের দিয়ে প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করা হবে। আগামী ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে পাইলট প্রক্রিয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। ৬. প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে প্রতিবেশী ও আসিয়ান দেশগুলোকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আগে মিয়ানমারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও মঙ্গলবারের বৈঠকে তারা বিষয়টিতে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে সম্পৃক্ত হবে তা’ আগামী বৈঠকে চূড়ান্ত করা হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হলে দলে-দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। কয়েক মাসের মধ্যেই সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। এ ছাড়া আগে থেকেই এখানে ছিল আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরত যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি কূটনৈতিক সাফল্যের ইতিবাচক দিক। চীন এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। আমরা চীনকে ধন্যবাদ জানাই। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবন যাপনের যতো দ্রুত অবসান হবে ততো লাভ।