এম এ হাওলাদার: খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার লাউডোব ইউনিয়নের কালিকাবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ্যারন মন্ডলের বেড়ে ওঠা সুন্দরবনের সাথে। তাই রঙের তুলিতেই ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দরবনের দৃশ্য। যেখানে গাছ-পালা-নদী-নালার পাশাপাশি বাঘ-হরিণ-কুমিরসহ নানান পশু-পাখির বাস। কিভাবে তাদের বিচরণ তার একটি চিত্র এঁকে বোঝাতে চাইলেন মায়ের মতো সুন্দরবন আমাদের প্রাণ। বিশেষ করে বন সংলগ্ন ওই এলাকার জীবন-জীবিকার সাথেও যে সুন্দরবন জড়িয়ে আছে সেটিও ফুটিয়ে তুলেছেন এ্যারন মন্ডল। এমন একটি ছবি এঁকে পুরষ্কারও পেয়েছেন। তার পাশাপাশি হোসাইন গাজী, সৃষ্টি মন্ডল, অর্থি মন্ডল, মৌসুমী সরকার, আজিজুল শেখ, অন্যন্যা সরকার, দ্রæব বাওয়ালীসহ অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন প্রতিযোগিতায়। সুন্দরবন বিষয়ক চিত্রাংকন, রচনা আর কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এসব কোমলমতি শিশুরা জানিয়ে দিলেন সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব সবার।
পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তারা আপাতত: দু’টি বিষয়ে শপথও নিয়ে বাড়ি ফেরেন। প্রথমত: আর কখনও হরিণ শিকার করবেন না, হরিণের মাংস খাবেন না এবং দ্বিতীয়ত: বিষ দিয়ে মাছ শিকারী ও হরিণ শিকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসব অবুঝ শিশুদের নিয়ে কেন এমন আয়োজন জানতে চাইলে আয়োজক সংস্থা ট্যুর অপারেটর এ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন-টোয়াস-এর সাধারণ সম্পাদক এম. নাজমুল আযম ডেভিড বললেন, এসব শিশুরাই একদিন বড় হবে, লেখাপড়া শেষে যাবে কর্মস্থলে, কেউ কেউ হয়তো গ্রামে থেকেই জীবিকা নির্বাহ করবে। বুঝে ওঠার আগেই যদি সুন্দরবনের গুরুত্ব বোঝানো যায়, সুন্দরবনের ভালোবাসা জাগ্রত করা যায়, এক কথায় সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব এসব কোমলমতি শিশুদের ওপর তুলে দেওয়া যায় তাহলেই সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনকে স্থায়ী রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।
টোয়াসের সভাপতি মোঃ মইনুল ইসলাম জমাদ্দার বলেন, টোয়াস শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন থেকেই নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও এমন আয়োজন করেছে। এর মধ্যদিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের মধ্যে সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারনা দেওয়াও সম্ভব হবে। এক কথায় নিজেদের স্বার্থে, এ অঞ্চলের স্বার্থে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার স্বার্থে সর্বোপরি দেশের স্বার্থে ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন রক্ষা করা যে প্রয়োজন সে বিষয়টি তুলে ধরতেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে এমন আয়োজন।
সুন্দরবন সংলগ্ন ইকো কটেজ বনলতা’র স্বত্ত¡াধিকারী সুদীপ্ত গাইন বলেন, দেশ-বিদেশের পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমনে এসে বন সংলগ্ন মানুষের কাছ থেকে যখন সুন্দরবন বিষয়ক নানা তথ্য জানতে পারবেন সেটি হবে ভ্রমনের স্বার্থকতা। এজন্য বন সংলগ্ন মানুষের মধ্যে সুন্দরবন বিষয়ক নানা তথ্যে সমৃদ্ধ করা দরকার। যে কাজটি টোয়াসের মত আরও অন্যান্য সংগঠন করতে পারে। এছাড়া স্থানীয় শিক্ষিত যুব সমাজের মধ্যদিয়েই তৈরি হতে পারে ‘গাইড’। বিদেশে ‘গাইড’ প্রথা বেশ প্রচলন। কিন্তু বাংলাদেশে শুধুমাত্র ট্যুর ব্যবসায়র সাথে জড়িতরাই গাইডের কাজটি করেন। অথচ ‘গাইড’ পর্যটন শিল্পের একটি অন্যতম পেশা হতে পারে।
লাউডোবের স্কুল শিক্ষক মুকুল সরদার বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে বা স্কুল আঙিনায় কোন বিলবোর্ডের মাধ্যমে সুন্দরবন বিষয়ক নানা তথ্য, বনের গাছ-পালা, পশু-পাখির পরিচয়সহ অন্যান্য তথ্যাদি তুলে ধরা যেতে পারে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পর্যটকদের জন্য তৈরি হতে পারে আকর্ষণীয় সেল্ফি স্ট্যান্ড। যেটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
এভাবেই সুন্দরবনের প্রচার-প্রসারে সবাই এগিয়ে আসলে পর্যটন শিল্পের জন্য এটিও হতে পারে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য আরও একটি শিল্প।
উল্লেখ্য, সুন্দরবন নিয়ে শিশুদের মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ তৈরির লক্ষ্যে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন (টোয়াস) এর উদ্যোগে সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চিত্রাঙ্কন, রচনা ও কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এই প্রতিযোগিতায় দাকোপ উপজেলার ১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে। প্রথম ধাপে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় যথা কালিকাবাটি, প্রফুল্ল কুমার, বি.কে. বড়বাঁক ও লাউডোব বানীশান্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতিযোগিতা শেষে অনুষ্ঠিত পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সুন্দরবন রক্ষায় বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরকে এখন থেকেই সচেতন করার জন্য এমন উদ্যোগ যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বক্তারা। সেই সাথে সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
বক্তারা বলেন, শিশু বয়স থেকেই শিশুদেরকে সুন্দরবনে প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা গেলে কর্মক্ষেত্রে তারা সুন্দরবন রক্ষায় আরও বেশি ভূমিকা পালন করতে পারবে। বক্তারা আমাদের সকলকেই সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার আহবান জানান।