সুন্দরবন একাডেমী’র
নির্বাহী পরিচালক

অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির

* গৌরবের পদ্মা সেতু, আর বাকী ১০ দিন

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ আর মাত্র ১০দিন বাকী স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে দেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহের বিষয়টিও দানা বাঁধছে। পদ্মা সেতু হলে উন্নয়নের কোন মাত্রায় পৌঁছে যাবে দেশ সে হিসাব-নিকাশও কষছেন অনেকে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু নিয়ে যারা দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন সেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যেন আগ্রহের শেষ নেই। এ অঞ্চলের শিল্প, বাণিজ্য, বন্দর, পর্যটন তথা অর্থনীতিতে কেমন ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু সেটি নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। দৈনিক পূর্বাঞ্চলকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বললেন, পদ্মা সেতুকে কেবলমাত্র একটি পারাপারের সেতু হিসেবে দেখলে হবে না। অর্থাৎ এটি শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নই করবে না, বরং পদ্মা সেতু হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক করিডোর। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণকে সামনে রেখে তিনি এ সাক্ষাতকার দেন।
একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, এতোদিন খুলনা থেকে ভোলা পর্যন্ত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বিচ্ছিন্ন ছিল শুধুমাত্র একটি নদীর কারণে। কিন্তু এই পুরো অঞ্চলটি হচ্ছে একটি সম্ভাবনাময়ী এলাকা। বিশেষ করে বরিশাল এখনও শষ্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত। শুধুমাত্র খুলনায় কৃষিজাত পণ্য কিছুটা কম হলেও যশোর বা সাতক্ষীরায় হতো। যদিও ইদানিং শেড ভিত্তিক কিছু কৃষিপণ্য উৎপাদন হচ্ছে খুলনায়। যেমন আগে তরমুজ হতো না, এখন হচ্ছে। অর্থনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে। এতে কৃষিজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে কৃষিজাত পন্যের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। আর এ অঞ্চলের কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানীর জন্য বিমানের সুবিধা নিতে হলে ফেরিঘাটেই ঘন্টার পর ঘন্টা এমনকি দিনের পর দিন বসে থাকতে হতো। যেটি অন্তত: কাঁচামালের ক্ষেত্রে সম্ভব না। পদ্মা সেতুর ফলে এ অঞ্চলের কাঁচামাল দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঢাকায় বিমান বন্দরে যেতে পারবে। ফলে এখানকার কৃষিজাত পণ্য রপ্তানীর সুযোগ বৃদ্ধি হবে। যেটি জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। যার ফলে প্রবৃদ্ধির হার দেশে একরম হলেও খুলনাঞ্চলে বেশি হবে।
পদ্মা সেতু হলে মংলা বন্দরের চিত্র বদলে যাবে এমনটি উল্লেখ করে অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, রাজধানী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মংলার চেয়ে বেশি পথ হলেও শুধুমাত্র একটি নদীর কারণে এতোদিন ঢাকার রপ্তানীযোগ্য পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিদেশে পাঠানো হতো। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হলেই মংলা হবে ঢাকার সবচেয়ে কাছের সমুদ্র বন্দর। সুতরাং মংলা বন্দরে আমদানী-রপ্তানী বাড়বে। মংলা বন্দরকে ঘিরেই বাড়বে অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্যতা। বাড়বে রপ্তানী, বাড়বে জাহাজের সংখ্যাও। যেটি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করবে।
এছাড়া পদ্মা সেতুর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশেষ করে সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ যেসব প্রতœতাত্মিক নিদর্শনসমূহ রয়েছে সেগুলোতেও পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে বলে জানান সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাধারণত পর্যটকরা যায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাধাহীনভাবে যেতে চায়। পদ্মা সেতুর ফলে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, বাগেরহাটসহ পর্যটন এলাকায় যাতায়াত করতে পারবে খুব সহজেই। এর ফলে ধীরে ধীরে পর্যটন শিল্পেরও উন্নতি হবে। পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে এটি মাথায় রেখেই ইতোমধ্যে পর্যটন ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন জাহাজ বানাচ্ছেন। পরিবহন ব্যবসায়ও যুক্ত করা হচ্ছে নতুন নতুন যানবাহন। শোনা যাচ্ছে ইতোমধ্যেই এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বিলাস বহুল বাসের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ এক পদ্মা সেতুই নানা ক্ষেত্রে শাখা-প্রশাখা বাড়াচ্ছে। পরিবহন, পর্যটন, কৃষি বিভিন্ন খাতে বাড়ছে কর্মসংস্থান।
পর্যটন শিল্পের বিকাশ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, দেশী পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় পর্যটকরাও আমাদের দেশে বেশি আসবে পদ্মা সেতু হলে। এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে শথকরা ৬৩ শতাংশ পর্যটক গেলেও ভারতের পর্যটকরা এদেশে আসে মাত্র এক শতাংশ। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে যাতায়াত। যখন পদ্মা সেতুর ফলে গোটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে তখন ভারতীয় পর্যটকরা আমাদের দেশে বেশি আসবে।
পদ্মা সেতু হলে খুলনার পাটশিল্প অতীত গৌরব ফিরে পাবে এমনটি উল্লেখ করে অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বিশে^ পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সুতরাং খুলনার বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারি পাটশিল্পকে নিয়ে নতুন করে ভাবলে পাটকলগুলো আবারও চালু হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন আর শ্রমঘন মিল চলবে না। সবকিছু চলে গেছে পুঁজিঘনতে। অর্থাৎ একটি পাটকলে যে পরিমান জায়গা রয়েছে সেখানে অন্তত: চারটি কারখানা করা সম্ভব। এভাবে নওয়াপাড়া থেকে খালিশপুর পর্যন্ত যেসব পাটকল রয়েছে সেগুলোকে ‘জুট প্রডাক্ট ইকোনমি জোন’ হিসেবে তৈরি করা যাবে। এসব জোনে পাট বিষয়ক বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা যাবে। আর এটি করা গেলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন। এছাড়া যেহেতু পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে আর কোন বিড়ম্বনা থাকছে না সেহেতু দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকরাও আসতে পারবে এখানে। এতে শ্রমের ও শ্রমিকের চলমানতা বাড়িয়ে দেবে। কর্মসংস্থানের বাজার সৃষ্টি হবে। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় বলেই প্রবৃদ্ধি বাড়ে। এরপর যখন মংলা ও খুলনার সাথে রেল সংযোগ হয়ে যাবে তখন দেশী-বিদেশী পণ্য আমদানী-রপ্তানীও বাড়বে। এছাড়া পদ্মা সেতু হলে খুলনা হবে শিক্ষা জোনও।
পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জিং একটি প্রকল্প উল্লেখ করে তিনি বলেন, বড় ধরনের একটি ঝুঁকি নিয়েই পদ্মা সেতু করা হয়েছে। প্রথমে বিশ^ ব্যাংকের সরে যাওয়ার পর যখন প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থ থেকে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দেন তখন অবশ্য চীন-জাপানসহ অন্যান্যরা এগিয়ে আসে। এরপর আবার বিশ^ ব্যাংক টাকা দিতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাখ্যান করেন। পদ্মা সেতুর মধ্যদিয়ে সরকার যে বিশ^ ব্যাংককে শিক্ষা দিতে পেরেছে এটিও বাংলাদেশের জন্য একটি আত্মসম্মানের বিষয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
পদ্মা সেতু ‘আর্টিটেকচারাল ডেভেলপমেন্টে’ একটা বড় ধরনের উদাহরণ বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির। তিনি বলেন, পৃথিবীর জন্য একটি অন্যতম নিদর্শন হবে পদ্মা সেতু। পদ্মা হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে সর্বনাশা নদীর মধ্যে অন্যতম। এই সর্বনাশাকে বসে এনেই কাজ করতে হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী হেমার দিয়ে কাজ করতে হয়েছে। আর দুর্নীতির যে কথাটি বলা হচ্ছে সেটি নিয়ে এখন আর কোন আলোচনার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি মিমাংসিত একটি বিষয়। কেননা আন্তর্জাতিক আদালতেই দুর্নীতি প্রমান হয়নি।
পদ্মা সেতুর ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমে এর সম্ভাব্যতা যাচাই হয় ১৯৯৮ সালে। এরপর যখন ব্যয় চূড়ান্ত হয় তখন রেল সেতু ছিল না। এছাড়া দু’পড়ের প্রায় নয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেস সড়ক, পদ্মার ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্থা এবং তিনগুন মূল্য দিয়ে জমি অধিগ্রহণ সর্বোপরি মালামালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে হারে ব্যয় বেড়েছে সেটি খুব বেশি নয়।
পদ্মা রেল সেতুর সংযোগ খুলনা পর্যন্ত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য যশোরের আগে সিঙ্গিয় থেকে একটি বাঁক হচ্ছে। যেখান থেকে খুলনার রেল চলে যাবে নড়াইল হয়ে পদ্মা সেতুতে। সুতরাং এ নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
পদ্মা সেতু চালুর পাশাপাশি খুলনাঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, মৃত অবস্থায় পড়ে থাকা শিল্পকে আগে চাঙ্গা করা দরকার। পাট শিল্পকে পাট শিল্প রেখেই এর মেশিনারিজ বিএমআরই(ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন এবং সম্প্রসারণ) করার মধ্যদিয়ে পুঁজিঘন শিল্পে চালু করা যেতে পারে বলেও তিনি মনে করেন। আর এ নিয়ে দেরি করা যাবে না। বরং এখনই এটি নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। সেই সাথে যে সড়কগুলো রয়েছে সেগুলোকে কমপক্ষে চার লেনে সম্ভব হলে ছয় উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি কিছু বিকল্প সড়ক নির্মাণ করতে হবে এখনই। তা না হলে বিদ্যমান সড়কের ওপর চাপ পড়বে সেটি সামাল দেয়া কঠিন হতে পারে।