পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) আদায়ের তোড়জোড় শুরু করেছে বাংলাদেশ। এজন্য খুব শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হবে। দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই চিঠি পাবে যুুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতর ইউএসটিআর। দেশটির নতুন প্রশাসনের সঙ্গে শুধু জিএসপি ইস্যুতে আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে রফতানি আয়ে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। গতি সঞ্চার হবে এলডিসি উত্তরণ এবং করোনা সঙ্কটের মুখে পড়া দেশের অর্থনীতি। বাড়বে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে যখন দায়িত্ব নেন সেই সময় জিএসপি পাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ট্রাম্প প্রশাসন তাতে সাড়া না দিয়ে বরং কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি ও শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়। এরপর আর জিএসপি ইস্যুতে কখনও আলোচনা হয়নি। এর আগে ২০১২ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের সকল পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক খাত উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসটিআরের এ্যাকশন প্লান ১৭টি শর্ত আরোপ করে। যদিও পোশাক রফতানিতে ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধার বাইরে রাখা হয়। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর আন্তর্জাতিক বাজারে চরম ভাবমূর্তি সঙ্কটেও পড়ে বাংলাদেশ। গত বছরের শেষ নাগাদ ইউএসটিআরের এ্যাকশন প্লানের ১৭ শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ও শ্রম অধিকার ইসুতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এখন আর তেমন কোন অভিযোগ নেই। এলডিসি দেশ হিসেবে রফতানিতে জিএসপি সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুসরণ না করে বাংলাদেশকে এই সুবিধার বাইরে রাখা হয়েছে শ্রম অধিকার ইস্যুতে ভিয়েতনামের অবস্থান বাংলাদেশের নিচে হলেও সেখানকার উদ্যোক্তারা পোশাক রফতানিতে জিএসপি সুবিধা পান। একইভাবে চীন, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জিএসপি সুবিধায় পণ্য রফতানি করছে। শুধু বাংলাদেশকে বড় অঙ্কের শুল্ক দিয়ে পোশাক রফতানি করতে হয়। আগামী ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ কারণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। অর্থনীতির কর্মকান্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে দ্রুত গতিশীল করতে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের কাছে পোশাক রফতানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য বা জিএসপি সুবিধা চাওয়া হবে। করোনা সঙ্কট ও এলডিসি উত্তরণে এই সুবিধায় প্রবেশ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। একক দেশ হিসেবে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ। অথচ শ্রম ইস্যুসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে জিএসপি সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, জিএসপি সুবিধা পাওয়া এবং এর পেছনে যেসব যুক্তি রয়েছে তা’ উল্লেখ করে একটি চিঠি ড্রাফট করে রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেয়ার পরই তা’ ইউএসটিআরে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আশা করছি, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে এই সুবিধা দেয়া হবে। ইউএসটিআরের এ্যাকশন প্ল্যানের বেশির ভাগ শর্ত ভালভাবে পূরণ করেছে বাংলাদেশ। শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন সব আন্তর্জাতিক সংস্থা দেশের গার্মেন্টস খাত নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করতে শুরু করেছে। জানা গেছে, রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার যৌক্তিক কারণগুলো বাইডেন প্রশাসনের কাছে উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ। এতে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা অর্থনৈতিক সঙ্কটগুলো একে একে দূর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। দেশটিতে রফতানির ৯৮ শতাংশ হচ্ছে পোশাক সামগ্রী। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার যা’ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় ৫১ হাজার কোটি এবং বিপরীতে আমদানি হয় ১৭ হাজার কোটি টাকার পণ্য। শুধু পোশাক রফতানির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রকে বছরে শুল্ককর দিতে হচ্ছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য প্রতিবছর বাড়ছে। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে কোন শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যায় না। যদিও পোশাকের বাইরে অপ্রচলিত ৯৭ ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে আবার শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে রাখা হয়েছে যা’ রফতানির ক্ষেত্রে কোন কাজে আসছে না। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাইডেন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলে বাংলাদেশ দ্রুত জেএসপি সুবিধা পাবে বলে আশা করা যায়। এতে করে আমাদের পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য রপ্তানি খাত সচল হবে।