সব ধরনের ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে সরকার। সহজ করে বললে তিন বছর মেয়াদী প্রকল্পের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ থেকে কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। গত বৃহস্পতিবার সরকারের নেয়া এমন সিদ্ধান্তে মাথায় যেন বাজ পড়েছে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের। চলতি মাস থেকে ব্যক্তি আমানতের সুদহারও কমিয়ে দিয়েছে বেসরকারী ব্যাংকগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যক্তি আমানতে ৬ শতাংশ সুদ বেঁধে দেয়ার ফলে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন বিনিয়োগে। বিশেষ করে ব্যাংকে আমানত রাখা কমিয়ে দেয়ায় বাসাবাড়িতে টাকা রাখার প্রবণতা বাড়তে পারে। এদিকে বাধ্যতামূলক ই-টিআইএন সার্টিফিকেট এবং ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে উৎসে কর বেড়ে যাওয়ায় কঠিন হয়ে পড়েছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। আবার ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে চাইছেন না অনেকে। আমানত নিয়ে নতুন এই অনিশ্চয়তার মধ্যে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, উচ্চ সুদের প্রলোভন দেখিয়ে বাড়তে পারে নানা ‘হায় হায়’ কোম্পানির দৌরাত্ম্য। সঞ্চয়কারীকে নিঃস্ব করে যে কোন সময় আবার হাওয়া হয়ে যেতে পারে তারা। এছাড়া একই সঙ্গে তারল্য সঙ্কট আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকগুলোর। জানা গেছে, সব ধরনের ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার কমিয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। তিন বছর মেয়াদী প্রকল্পের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ থেকে কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। অনুরূপভাবে দুই বছর মেয়াদী সঞ্চয় প্রকল্পের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ, যা’ আগে ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর এক বছর মেয়াদে সুদহার ১০ দশমিক ২০ থেকে কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশ। ডাকঘরের আমানতকারী চাইলে প্রতি ছয় মাস অন্তর মুনাফা উত্তোলন করতে পারেন। আর সেখানেও সুদের হার কমবে। প্রথম বছরে ৪, দ্বিতীয় বছরে সাড়ে ৪ ও তৃতীয় বছরে ৫ শতাংশ হারে মুনাফা মিলবে। আগে যা’ ছিল যথাক্রমে ৯, সাড়ে ৯ ও ১০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন সুদহারে ডাকঘরে টাকা রাখলে প্রকৃত মুনাফা বলে কিছুই থাকবে না। কারণ বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার আর ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পের সুদের হার প্রায় একই বা তার চেয়েও কম। ফলে এখানে টাকা রাখলে প্রকৃত অর্থে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে তারা সঞ্চয়ে নিরুৎসাহিত হবেন। সঞ্চয়ে তাদের আগ্রহ কমে যেতে পারে। জনগণের আমানত অপ্রচলিত খাতে চলে গেলে ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট আরও বাড়তে পারে। ফলে নতুন করে অনেক ধান্দাবাজ প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠবে। ফলে ঋণের সুদ কমানোর লক্ষ্যে শুধু আমানতের সুদ কমানোর ওপর জোর না দিয়ে খেলাপী ঋণ আদায়, উচ্চ খরচ কমানোর পাশাপাশি বড় মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ব্যাংকগুলোকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এদিকে চলতি মাস থেকে ব্যক্তি আমানতের সুদহারও কমিয়ে দিয়েছে বেসরকারী ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংক আমানতে সুদহার ৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে বেসরকারী ব্যাংকগুলো। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ব্যাংক মেয়াদী স্কিম ছাড়া সব ধরনের আমানতের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে। তবে যেসব আমানতের মেয়াদ শেষ হবে, সেগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এর আগে গত ২০ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে বলা হয়, বেসরকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরকারী আমানতের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত রাখা যাবে। এই আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ পাবে সরকারী সংস্থাগুলো। আর সরকারী ব্যাংকে আমানত রাখলে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ শতাংশ সুদ নিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত ডিসেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন ধরা যাক, কোন ব্যক্তি এক লাখ টাকার মেয়াদী আমানত রাখলেন। ৬ শতাংশ হারে বছর শেষে তিনি পেলেন ১ লাখ ৬ হাজার টাকা। তবে মূল্যস্ফীতির কারণে এখন ১ লাখ টাকায় যে পণ্য কিনতে পারছেন, ১ বছর পরে তা’ কিনতে খরচ করতে হবে ১ লাখ ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। এর মানে, নিট তিনি পেলেন ১ লাখ আড়াইশ’ টাকা। তবে টিআইএন না থাকার কারণে পুরো ৬ হাজার টাকা মুনাফার ওপর তাকে উৎসে কর দিতে হবে ৬শ’ টাকা। এর ওপর বছরে দুই দফায় চারশ’ টাকা চার্জ নেবে ব্যাংক। এর মানে, ১ লাখ টাকা রেখে বছর শেষে তিনি আসলে পাচ্ছেন ৯৯ হাজার ২৫০ টাকা। আমরা মনে করি, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের একটি ভরসা স্থল ছিলো। বিশেষ করে সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষকদের। তারা নিরাপদ ও বিশ্বস্ত জায়গা হিসেবে এটা বেছে নেন। কিন্তু সুদের হার অর্ধেকে নেমে যাওয়ায় তারা এখন গভীরভাবে হতাশ। তারা যা’ কিছু সঞ্চয় করেন তা’ এখন বিনিয়োগ করবেন কোথায়? নিরাপদ বিনিয়োগের জায়গাই বা কই? তবে এই সঞ্চয় প্রকল্পে বিত্তশালীরাও ঢুকে পড়ায় বিপত্তি। তাই সঞ্চয়ের সুদের হার কমানোর অনেকগুলো লক্ষ্যও আছে। তবে তার ওপর এমন কিছু করা হোক যেখানে অন্তত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয়ে ৬ ভাগের স্থলে ৭-৮ ভাগ লাভ দাঁড়ায়।