খুলনা জেলা সিপিবি সভাপতি

ডা: মনোজ দাশ
* গৌরবের পদ্মা সেতু, আর বাকী ১২ দিন

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি-সিপিবি’র খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ডা: মনোজ দাশ বলেছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পাশাপাশি পুরোপুরি সুফল পেতে নিতে হবে সমন্বিত পরিকল্পনা। তাছাড়া সবকিছু রাজনীতিবিদ বা আমলাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। বরং দেশের বুয়েট, কুয়েটসহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গ এমনকি নাগরিক নেতাদের মধ্য থেকেও যারা এসব বিষয় নিয়ে ভাবেন তাদেরকে সম্পৃক্ত করার মধ্যদিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
দৈনিক পূর্বাঞ্চলকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে জেলা সিপিবি সভাপতি আরও বলেন, বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে এটি অবশ্য একটি বিরাট ইতিবাচক দিক। প্রথম দিক থেকেই পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক দিকটি নিয়ে সিপিবি কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে কথা বলে আসছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হওয়া মানেই হচ্ছে রাজধানী ঢাকার সাথে পদ্মার এপারের ২১ জেলার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়ে যাওয়া। মানুষ এবং পণ্যের যাতায়াতে ও পরিবহনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে এ সেতুর মধ্যদিয়ে। সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি সবল হবে এবং জিডিপিও এ ক্ষেত্রে বাড়বে।
কৃষি ক্ষেত্রের দিক তুলে ধরে ডা: মনোজ দাশ বলেন, আমাদের এই অঞ্চলের কৃষি বরাবরই অনুন্নত। কৃষি পণ্য পরিবহনে একটি প্রতিবন্ধকতা আছে দীর্ঘদিন ধরে। পদ্মা সেতুর সুফল যদি যথার্থভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে এই অঞ্চলের কৃষকরা তাদের পণ্যের লাভজনক মূল্য পাবে। পণ্য সরবরাহে তারা সংকট থেকে মুক্ত হবে।
এছাড়া পদ্মা সেতুর মধ্যদিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে এই অঞ্চলের শিল্পের উন্নয়ন হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেই সাথে নি:সন্দেহে এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। সুন্দরবন, খানজাহান(রহ:) এর স্মৃতি বিজড়িত ষাট গম্বুজ মসজিদসহ অন্যান্য অনেক প্রতœতাত্মিক নিদর্শন থাকার পরও শুধুমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থার অনুন্নয়নের কারণে এতোদিন পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটতে পারেনি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তিনি বিগত দিনের সরকারগুলোর পক্ষ থেকেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করেন। তবে পদ্মা সেতু হলে এ অঞ্চলকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্রের বিকাশ ঘটবে বলেও তিনি আশা করছেন।
পাশাপাশি পদ্মা সেতুর সুফল যথার্থভাবে কাজে লাগে লাগাতে পারলে মংলা বন্দর পর্যন্ত এর প্রভাব পড়বে। মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর এবং বেনাপোল ও ভোমরা স্থল বন্দরও উন্নত হবে।
তবে তিনি পদ্মা সেতুর ব্যয় সম্পর্কে বলেন, ২০০৭ সালে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। পরে দু’বার ব্যয় বাড়িয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। বিশে^র অন্যান্য দেশে এরকম খর¯্রােতা নদীতে সেতু করতে ব্যয় একটু বেশি হয় ঠিকই, কিন্তু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সে তুলনায় ব্যয় হয়েছে তিন গুনেরও বেশি। এ ক্ষেত্রে তিনি বৈদেশিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে পদ্মা সেতু করার জন্য সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে সঠিকভাবে তদন্ত করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
অবশ্য পদ্মা সেতুকে ঘিরে খুলনাঞ্চলে যে শিল্পায়ন হবে সেগুলোকে তিনি পরিবেশবান্ধব করার আহবান জানিয়ে বলেন, মংলা ইপিজেডসহ যেসব অর্থনৈতিক জোনের কথা বলা হচ্ছে সেসব স্থানে যে কোন শিল্পায়ন হোক না কেন তা’ অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব হতে হবে। তা না হলে আমাদের সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। মংলা ইপিজেড ও সুন্দরবনের আশপাশে পরিবেশ বিধ্বংসী শিল্পায়ন থেকে বিরত থেকে তিনি পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানান।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও পরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানান এই সিপিবি নেতা। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সাথে সাথেই খুলনা-ঢাকা ভায়া মাওয়া সড়কে যে হারে যানবাহনের চাপ বাড়বে সেটিকে সামাল দিতে এখনই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। যে সড়ক রয়েছে সেটিকে প্রসস্তকরণ ও মজবুত করার পাশাপাশি বিকল্প কয়েকটি সড়ক করার ব্যাপারেও তিনি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানান।
পদ্মা সেতু চালু হলেই এ অঞ্চলের শিল্প ও কৃষিতে অবদান রাখার কথা বলা হলেও অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, কোন দেশে একটি সেতু স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোন শিল্পায়ন ঘটায়নি। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু হলে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হবে এমনটি বলা হলেও যে পরিমাণ আশা করা হচ্ছিল সে পরিমাণ হয়নি। বরং ওই এলাকায় আগেই শিল্প ও কৃষিতে উন্নয়ন ছিল। ফলে যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার ফলে তারা সেটিকে কাজে লাগাতে পেরেছে। সেতুর ফলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিল্প ও কৃষিতে সুবিধা পাওয়া গেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেখানে নতুন কোন শিল্পায়ন হয়নি। বরং কৃষি ক্ষেত্রে মধ্য সত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সরাসরি কৃষক লাভবান হয়নি এবং কৃষকের যে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল সেটি আর সংগত কারণে লাভজনক হয়নি। এজন্য তিনি খুলনাঞ্চলের কৃষি ও শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ, সরকারের ভুলনীতি ও পুঁজিবাদের উদার লুটপাটের অর্থনীতি থেকে সরে এসে আত্মনির্ভরশীল, লুটপাটমুক্ত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তাহলেই কৃষি ও শিল্পে একটি পরিবর্তন আশা করা যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সার্বিকভাবে জনকল্যাণে এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু যেন অবদান রাখতে পারে সেজন্য সরকারকে আন্তরিক হওয়ার পাশাপাশি তিনি এ অঞ্চলের জনগনকেও সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান। পদ্মা সেতুর পাশাপাশি বাংলাদেশের জনকল্যাণে পদ্মা রেল সেতুকে দুর্নীতিমুক্ত করে সত্যিকার অর্থেই কল্যাণকর করার দাবি জানান। পদ্মা সেতু আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা করছেন। সেজন্য রেল সংযোগকে তিনি খুলনা, মংলাসহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সাথে সম্পৃক্ত করার দাবি জানান।
পদ্মা সেতুর পাশাপাশি তিনি খানজাহান আলী(রহ:) বিমান বন্দরের কাজও দ্রুত এগিয়ে নেয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন, বিমান বন্দর শুধু যাতায়াতের ক্ষেত্রেই অবদান রাখবে না, বরং মংলা বন্দর, ইপিজেডসহ অন্যান্য স্থানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। অবদান রাখবে পর্যটন শিল্পেও। সবচেয়ে বড় অবদান রাখবে স্বাস্থ্যসেবায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেক সময় খুলনা থেকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী ঢাকায় নিতে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। কিন্তু বিমান বন্দর থাকলে মাত্র দু’ বা তিনটি আসন নিয়েই অল্প খরচে খুলনাঞ্চল থেকে ঢাকায় মুমূর্ষু রোগী নেয়া যাবে।
সর্বোপরি বিশ^ ব্যাংকের অর্থায়ন থেকে ফিরে যাওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকে তিনি ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্যদিয়ে এদেশের জনগণকে আত্মবিশ^াসী করেছে বলেও তিনি মনে করেন।