এ এইচ হিমালয় : ভবনজুড়ে আলোকসজ্জা। ফুলে ফুলে সাজানো মঞ্চ, সাজানো ছিল ফটক। নাচ-গাণের মাঝে চলছে হলুদ উৎসব। বাদ যায়নি আতশবাজির রোশনাই। এর আগে দুপুরে ছিল রঙ উৎসব। সব শেষে ভুরিভোজ তো ছিলই।
উচ্চবিত্ত পরিবারের বিয়ে বাড়ির মতোই ছিল সব আয়োজন। উৎসবের কমতি ছিলো না কোথাও। বিয়ের দিন বরের গেট ধরা থেকে, জুতো চুরি সবই হয়েছে। আনন্দমুখর এই আয়োজনটি কারও বাড়িতে নয়; ছিল খুলনার সরকারি শিশু (বালিকা) পরিবারে। বাবা অথবা মা হারা এতিম ১০১ শিশুর আশ্রয়স্থল এই পরিবার।
উৎসবের কেন্দ্রে ছিলো এই পরিবারের বেড়ে ওঠা মেয়ে আয়শা মিনা। আর এতে আলো ছড়িয়েছে ওই পরিবারের সদস্য ১০০ অনাথ শিশু। হলুদের রাতে সবাই হলুদ শাড়ি, বিয়ের দিন মেরুন লেহেঙ্গা পরে তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে রঙিন হয়ে ওঠে শিশু পরিবার। শিশুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে বিয়ের আয়োজনে যোগ দিয়েছিল খুলনার মহৎপ্রাণ কিছু মানুষ।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন খুলনার সরকারি শিশু পরিবারের (বালিকা) অবস্থান নগরীর সাউথ সেন্ট্রাল সড়কে। এতিম শিশুদের লেখাপড়া, থাকা-খাওয়া এবং ১৮ বছর পূর্ণ হলে তাদের বিয়ে ও পুনবার্সন করে শিশু পরিবার। পুনর্বাসনের অংশ হিসেবেই শুক্রবার দুপুরে আয়শা মিনার বিয়ের আয়োজন করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে ছিল হলুদ অনুষ্ঠান।
কর্মকর্তারা জানান, ২০১৩ সালে বাবা হারা আয়শার আশ্রয় হয় শিশু পরিবারে। গত ১০ বছরে এখানে থেকেই লেখাপড়া করছে। আয়শা এবার নগরীর সরকারি পাইওনিয়ার গার্লস কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বর মোহাম্মদ হোসেন পুলিশের নায়েক হিসেবে কর্মরত, বাড়ি সাতক্ষীরা জেলা সদরে। বর্তমানে তিনি খুলনা জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত রয়েছেন।
খুলনার শিশু পরিবার বালিকায় শুক্রবার পর্যন্ত ১০১ জন মেয়ে শিশু ও তরুণী রয়েছে। এর মধ্যে আয়শা মিনা চলে যাওয়ায় এখন সেখানে রয়েছে ১০০ জন।
আয়োজনের উদ্যোক্তা শিশু পরিবার বালিকার উপতত্ত্বাধায়ক আবিদা আফরিন জানান, এর আগেও শিশু পরিবারের অনেকের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এবারের আয়োজনটি ছিল ভিন্ন। তিনি বলেন, বিয়ে-হলুদ অনুষ্ঠানের মতো বর্ণিল আয়োজনে এখানকার শিশুরা অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় না। তাদের মাঝে বিয়ের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে আয়শা মিনার বিয়ে ধুমধাম আয়োজনে করার সিদ্ধান্ত হয়। আমাদের দাতা সদস্য, রোটারি ক্লাব অব সুন্দরবনসহ বিভিন্ন মানুষ এতে এগিয়ে আসে।
বৃহস্পতিবার রাতে শিশু পরিবারের গিয়ে দেখা গেছে, হলুদ শাড়ি পরা শত শিশুর ছুটে বেড়ানো, নাচগানে মুখরিত পুরো এলাকা। তাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে রোটারি ক্লাব অব সুন্দরবনের সদস্যসহ সমাজসেবা পরিবারের সদস্যরাও যুক্ত হন। তারাও গান গেয়ে নেচে শিশুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেন।
শুক্রবার দুপুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে শিশুদের পড়নে ছিল মেরুন রঙের লেহেঙা। বরকে নিয়ে নানান আয়োজনে প্রাণবন্ত ছিলো সবাই। নতুন বর-কনেকে শুভেচ্ছা জানাতে সেখানে হাজির হন খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকসহ জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
বিয়ের আয়োজনে তত্ত্ববধায়ন করছিলেন খুলনা জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা খান মোতাহার হোসেন। পূর্বাঞ্চলকে তিনি বলেন, শিশু পরিবারের মেয়েদের বিয়ে আমরা সব সময় ধুমধামে দেওয়ার চেষ্টা করি। এতো বর্ণিল আয়োজন আমাদের মেয়েদের বিয়েতেও হয় না। তিনি জানান, খুলনার মেয়র, সংসদ সদস্য, জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনসহ শিশু পরিবারের সদস্যদের সবাই ভালোবাসেন। সবার সহযোগিতায় আয়োজনগুলো সফল হয়।
আয়শার মা কহিনুর বেগম ও বোনেরাও এসেছিল বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিয়ের বর্ণিল আয়োজন দেখে কিছু সময় পর চোখ মুছতে দেখা যায় তাদের। কহিনুর বেগম জানান, এভাবে ওর বিয়ে হবে আমার কল্পনায়ও আসেনি। ওর জন্য সবাই দোয়া করবেন।
বরের বাবা ওয়াহিদুর রহমান মোরেলগঞ্জে পৌরসভায় কর্মরত রয়েছেন। একমাত্র সন্তানের বিয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুরু থেকেই ওর মায়ের ইচ্ছা ছিলো এমন একটি মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে হবে।
বর মোহাম্মদ হোসেন পূর্বাঞ্চলকে বলেন, পুলিশে চাকরি পাওয়ার পর থেকে এসপি স্যার বলে আসছেন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। বিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এটাও অসহায় কারও পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে শুরু করার ইচ্ছা ছিলো। আমার মায়েরও ইচ্ছা ছিল সবচেয়ে বেশি। আমরা সবার দোয়া প্রার্থী।
রোটারি ক্লাব অব সুন্দরবনের পক্ষে খুলনা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মফিদুল ইসলাম টুটুল পূর্বাঞ্চলকে বলেন, শিশুরা সবাই আমাদের সন্তানের মতো। এজন্য আমাদের স্লোগান ছিলো ‘আমাদের মেয়ে আয়শা মিনা’র বিয়ে। তিনি বলেন, আমাদের সবারই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা-ভালোবাসা নিয়ে আমরা শিশুদের পাশে দাঁড়িয়েছি।