উজান থেকে আসা ঢলে সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বাকি দুই জেলা শহর হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। আগামী দুই দিনে এই পানি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।প্রকৃত পক্ষে সিলেট ও সুনামগঞ্জে কত লোক দুর্গত হয়ে পড়েছেন তার সঠিক হিসাব করা এখন অনেকটা কঠিন। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ায় অনেক স্থানে মোবাইল নেট ওয়ার্ক নেই। সিলেটের লামাকাজিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষকে উদ্ধারের জন্য এলাকাবাসী আর্তনাদ করছেন। সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকায় দেখা যায়। পশ্চিম দিকে সুনামগঞ্জ মুখি রাস্তা দিয়ে ট্রাক ভর্তি বানভাসি মানুষ সিলেট নগরীতে উঠছেন। ভয়াবহ পরিস্থিতি ও বানবাসীর অসহায়ত্ব আসলে লিখে শেষ করা যাবেনা কিংবা বুঝানোও সম্ভব নয়।বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এর পর বেশির ভাগ বন্যা মূলত হাওর ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দুই তিন দিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা হয়নি।বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওর এলাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে। সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ, উজানে আগামী দুই দিন অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।প্রকৃত পক্ষে সিলেট ও সুনামগঞ্জে কত লোক দুর্গত হয়ে পড়েছেন তার সঠিক হিসাব করা এখন অনেকটা কঠিন।
প্রকৃত পক্ষে সিলেট ও সুনামগঞ্জে কত লোক দুর্গত হয়ে পড়েছেন তার সঠিক হিসাব করা এখন অনেকটা কঠিন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা সিএমডব্লিইউর পূর্বাভাস অনুযায়ী, শনিবার বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে-যা ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এসময় সিলেট ও সুনামগঞ্জে দেড় হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন। এই অল্প কয়েক দিনে এত বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১০০ বছরে নেই।বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, গোয়াইনসহ বেশির ভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। নদ-নদীর বুক উঁচু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানির ঢল ধরে রাখতে পারছে না। ফলে পানি উপচে দ্রুত বসতি ও শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।হাওর এলাকায় কৃষিকাজসহ নানা তৎপরতার কারণে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। যে কারণে বন্যার পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল ৬টায় সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সামনে সুরমা নদীতে সেকেন্ডে ১২ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। পানির উচ্চতা বিপৎসীমার প্রায় ১ মিটার ওপরে ছিল। স্বাধীনতার পর দেশের ওই এলাকায় এত উঁচু দিয়ে এবং এত বিপুল পরিমাণে পানি আসেনি।এ ব্যাপারে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল বলেন, চেরাপুঞ্জিসহ আশপাশের এলাকাগুলো এমনিতেই বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। এবার বঙ্গোপসাগর বেশি উত্তপ্ত থাকায় মেঘ ও মৌসুমি বায়ু বেশ শক্তিশালী ছিল। যে কারণে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। ফলে এবারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নদীগুলোকে দ্রুত খনন করে এর পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নয়তো প্রায় বছর আমাদের এ ধরনের বন্যার মুখে পড়তে হবে।সিলেটে বন্যার্তদের নগদ ৭০ লাখ টাকা ও ৮ হাজার ব্যাগ শুকনো খাবার বরাদ্দ:বন্যার্তদের সহায়তায় নতুন করে আরও খাবার ও নগদ অর্থ বরাদ্দ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে যোগাযোগ রাখছেন বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্যার্ত মানুষের মাঝে নগদ ২০ লক্ষ টাকা ও ৮ হাজার ব্যাগ শুকনো খাবার বরাদ্দ দিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এর আগে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানান, ইতোমধ্যে বন্যার্তদের উদ্ধার তৎপরতায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। শুক্রবার সকাল থেকে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৮টি উপজেলায় সেনাবাহিনীর ৮টি ব্যাটালিয়ন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, দিরাই, জামালগঞ্জ উপজেলাসহ মোট ৮টি উপজেলায় কাজ করছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পর্যাপ্ত নৌকা ও উদ্ধারকর্মী না থাকায় সুনামগঞ্জ শহরেই অনেকেই ঘরে ভিথরে আটকা আছেন। তারা উদ্ধারের আশায়। পানিতে আটকাপড়া মানুষ উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।