সোহেল মাহমুদ ॥ ‘আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সুন্দরবনে কাঠ পাচার কমেছে। পাশাপাশি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষের মধ্যেও সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা তৈরি হয়েছে। আর যেসব কাঠ উদ্ধার হয়েছে তার অধিকাংশই জ্বালানি কাঠ।’
বন বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী উদ্যোগে সুন্দরবন থেকে কাঠ পাচার অনেক কমেছে। বনবিভাগের দাবি, অতীতে সুন্দরবনের কাঠ পাচারের প্রচুর সংবাদ পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার ঘনফুট কাঠ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে কর্তন নিষিদ্ধ সুন্দরী ও কাকড়া কাঠ রয়েছে প্রায় ৫০০ ঘনফুট। সুন্দরবনের মূল্যবান গাছ পাচার বন্ধ ও বন্যপ্রাণী শিকার ঠেকাতে কঠোর নজরদারি চালাচ্ছেন বনবিভাগের স্মার্ট পেট্রোলিং টিমের সদস্যরা। অন্যদিকে, কোস্ট গার্ড সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকায় জীব-বৈচিত্র্য, বনজ সম্পদ রক্ষার পাশাপাশি চোরাচালান বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ নিয়েছে। সুন্দরবনের কাঠ পাচার বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (খুলনা সার্কেল) মো. মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘সুন্দরবনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সার্বক্ষণিক টহল ব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি স্মার্ট পেট্রোলিং চালু আছে।’ তিনি জানান, গত বছর ৪৫১ জন বন অপরাধীকে আদালতে সোপর্দ করে ৫৯২টি মামলা করা হয়েছে।
মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সুন্দরবনে কাঠ পাচার কমেছে। পাশাপাশি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষের মধ্যেও সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা তৈরি হয়েছে। আর যেসব কাঠ উদ্ধার হয়েছে তার অধিকাংশই জ্বালানি কাঠ।’ বন সংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘সুন্দরবনে ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মধু আহরণের অনুমতি দেয়া হয়। তবে বর্তমান আইনের আওতায় সুন্দরবনকে রক্ষা করার জন্য বনজীবীসহ সব শ্রেণির মানুষের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। ‘সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় থাকায় এবং প্রাকৃতিব দুর্যোগ কম হওয়ায় এ বছর বনে গাছ, ফুলের পরিমাণের পাশাপাশি মধুর উৎপাদনও বেড়েছে।’
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও কাঠ ও বণ্যপ্রাণী পাচারের প্রবণতা কমার তথ্য মিলেছে। দাকোপের বাসিন্দা শিপন ভূইয়া বলেন, ‘আগে সুন্দরবনের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন চক্র কাঠ, বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী পাচারে সক্রিয় ছিল। তবে গত কয়েক বছর এগুলো নেই বললেই চলে।’ শিপন বলেন, ‘সুন্দরবনের কাঠের একটা বড় অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হতো, কিন্তু বর্তমানে উপকূলের মানুষও গ্যাস ব্যবহার করে। চাহিদা না থাকায় বনের কাঠ চুরি এখন নেই বললেই চলে।’
সুন্দরবন সংলগ্ন সুতরখালি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মাসুম আলি ফকির বলেন, ‘সুন্দরবনের খুলনা অংশে বিশেষ করে দাকোপ, পাইকগাছা, কয়রা অঞ্চলে গত কয়েক বছরে কাঠ পাচারের তেমন কোনো ঘটনা নেই। আগে স্থানীয়রা কিছু জ্বালানি সংগ্রহ করলেও বর্তমানে সেই প্রবণতা নেই। এছাড়া অতিথি পাখিসহ বন্যপ্রাণী শিকারের ঘটনাও নেই।’
বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি সুন্দরবন এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সুরক্ষিত। চোরাচালান বন্ধ ও দস্যুমুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
সুন্দরবনের সুতারখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা প্রেমানন্দ মজুমদার বলেন, ‘গত ১ বছরে আমাদের স্টেশনে কাঠ উদ্ধার হয়েছে ১১৭ ঘনফুট। এর মধ্যে কর্তন নিষিদ্ধ সুন্দরী কাঠ সাত ঘনফুট।’ সুন্দরবনের পরিস্থিতির উন্নতির কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সবাই এখন জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করছে। পাশাপাশি ঘর তৈরিতেও এখন কাঠের ব্যবহার কম। সব মিলিয়ে সুন্দরবনের কাঠের চোরাচালান কমেছে।’ নলিয়ান রেঞ্জের বন বিভাগের দীর্ঘদিনের বোট ম্যান অশিথ ম-ল। তিনি বলেন, ‘আগে এখানে প্রচুর কাঠ ধরা পড়লেও গত ১০ বছরে বনের কাঠ পাচার হয় না বললেই চলে।’
বন বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী উদ্যোগে সুন্দরবন থেকে অপরাধ কমলেও ১৯ জানুয়ারী মঙ্গলবার শরণখোলার রায়েন্দা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা থেকে বাঘের চামড়াসহ এক জন আটক এবং ২২ জানুয়ারি শুক্রবার শরণখোলার রায়েন্দা বাসস্টান্ড সংলগ্ন এলাকা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ দুই জন আটক হয়েছে। কাঠ পাচার বন্ধ হলেও থামছেনা বন্যপ্রাণি হত্যা ও পাচার।