খালিশপুর বিআইডিসি সড়ক
* ১০০ ফুট জায়গার ৫০ ফুটই বেদখলে
* সাড়ে ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কের
দুই পাশে প্রায় ৪ হাজার স্থাপনা
* দুই ও তিন তলা ভবন রয়েছে শতাধিক
* রেল ভাড়া নেয় প্রতি ফুট ৪০
টাকা, কেসিসি ৭৫ পয়সা
এ এইচ হিমালয় ॥ পাইপলাইন স্থাপনের জন্য খোঁড়া গর্তে গত কয়েকবছর ধরে ক্ষতবিক্ষত খুলনার খালিশপুর বিআইডিসি সড়ক। কয়েক দশক আগে নির্মিত দুই পাশের ড্রেনও ভেঙ্গে গেছে অনেক স্থানে। এর মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরামর্শকরা পানি নিস্কাশনের জন্য সড়কটির দুই পাশে প্রশস্ত ড্রেন নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন।
এই সব কিছু মাথায় রেখে বিআইডিসি সড়কটি প্রশস্তকরণের পরিকল্পনা নিয়েছেন কেসিসির মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে সিটি মেয়রকে।
সড়কটি ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কের দুই পাশে কেসিসির মোট জমি ১০০ ফুট। স্থান ভেদে ৫০ ফুটই অবৈধ দখলে চলে গেছে। সড়কের দুই পাশের কেসিসির জমিতে তৈরি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। এর মধ্যে তিন ও চার তলা ভবন রয়েছে শতাধিক। জমি দখল করে ভবন নির্মাণের তালিকায় রয়েছেন সরকারি দলের স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। সড়ক প্রশস্ত করতে অধিকাংশ স্থাপনাই অপসারণ করতে হবে। এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করা আদৌ সম্ভব কি-না এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
কেসিসির সম্পত্তি শাখা থেকে জানা গেছে, ষাটের দশকে সড়কটি নির্মাণ করেছিলো বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি)। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য দুই পাশের ১০০ ফুট জায়গা ১৯৭৬ সালের ১৯ আগস্ট খুলনা পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই সময় ১০০ ফুট জায়গার মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ ফুট জায়গায় সড়ক, ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণ করা হয়। বাকি জায়গায় দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর তৈরি করে থাকতে শুরু করেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের কাছ থেকে হাতবদল হয়ে জমি চলে যায় প্রভাবশালীদের দখলে। এরপর কেসিসির জমিতে তৈরি হতে থাকে পাকা স্থাপনা, বহুতল ভবন।
সড়কটি ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের প্রাণ এই বিআইডিসি সড়ক। কেসিসির ৭, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩ ও ১৫ নং ওয়ার্ড অর্থাৎ মোট ৭টি ওয়ার্ডের সীমানা পড়েছে সড়কের দুই পাশে। এর মধ্যে উত্তর পাশের অর্থাৎ পাটকলের অংশের পুরো জমিই কেসিসির। বিপরীত অংশের কিছু জমি কেসিসির, কিছু জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের। সড়কের দুই পাশে ঠিক কতোটি দোকান আছে-তার তালিকা নেই কারও কাছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, সড়কের দুই পাশের ব্যবসায়ীদের ৫টি সংগঠন রয়েছে। পৃথকভাবে হিসাব নিয়ে দেখা গেছে, সংগঠনের সদস্য আছেন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। সবাই কেসিসির জমিতে দোকান তৈরি করে, কেউ ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। কেসিসির সড়ক সম্প্রসারণের উদ্যোগে আতংক দেখা দিয়েছে সবার মধ্যে।
সড়কের বায়তুল মামুন জামে মসজিদের সামনে সানজিদা ইলেট্রনিক নামের দোকানের ব্যবসায়ী শুকুর আলী বলেন, ১৫ বছর আগে পজিশন কিনে ব্যবসা করছি। এখন ভেঙ্গে দেওয়ার খবর শুনে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের দোকান রেখেই সড়ক প্রশস্ত করলে আমরা বেঁচে যাই।
খালিশপুর বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাহিদুর রহমান বলেন, পাটকলগুলো যখন সচল ছিলো তখন সড়ক প্রশস্তকরণের প্রয়োজন হয়নি। এখন তো শিল্পনগরী মৃত। তিনি বলেন, বর্তমানে ড্রেন, ফুটপাত সড়ক যেটুকু প্রশস্ত রয়েছে, সেটুকু প্রশস্ত করলে ব্যবসায়ীরা বেঁচে যাবে।
॥ ভাড়া মাত্র ৭৫ পয়সা ॥
কেসিসি থেকে জানা গেছে, সড়কের দুই পাশের জমিতে মালিকানা বজায় রাখতে ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ভাড়া কার্যক্রম চালু করে কেসিসি। বর্তমানে প্রতি বর্গ ফুটের ভাড়া ৭৫ পয়সা। তারপরও সাড়ে ৪ হাজার ব্যবসায়ীর মধ্যে ভাড়া দিয়েছেন মাত্র ৮৫০ জন। এর মধ্যে নিয়মিত ভাড়া দেন মাত্র ২৫০ জন।
কেসিসির রাজস্ব কর্মকর্তা মো. অহিদুজ্জামান খান পূর্বাঞ্চলকে বলেন, বিআইডিসি সড়কের মিল অংশে ড্রেন ও ফুটপাতের পাশে কেসিসির জমি। এর পরেই রেলওয়ের জমি। অনেক ব্যবসায়ী কেসিসির ২০ ফুট, রেলওয়ের ২৫ ফুট নিয়ে দোকান করেছেন। দেখা যায়, ওই ব্যবসায়ী কেসিসির জমির ভাড়া দেন প্রতি বর্গ ফুট ৭৫ পয়সা। অথচ রেলওয়ের জমির ভাড়া দেন প্রতি বর্গ ফুট ৪০ টাকা।
॥ দখল নিতে শোকতাপ নেই ॥
অন্যের জমির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ করলেও এনিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি দখলদারদের মাঝে।
আলমনগর মোড় থেকে বেশ কিছুটা সামনে এগোলে ৪ তলা ভবনের নিচতলায় তাহের ফার্নিচার। প্রতিষ্ঠানের মালিক আবু তাহের বলেন, ৪০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। উচ্ছেদ হলে কোথায় যাব ? সরকারি জমিতে ভবন নির্মাণের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবার দেখাদেখি ৪ তলা ভবন করেছি। কেউ তো নিষেধ করেনি।
সড়কের দুই পাশে ৩-৪ তলা ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিতে দেখা গেছে অনেককে। ঝালিকাঠি ভিলা নামের একটি ভবনে বাড়ি ভাড়ার সাইনবোর্ড ঝুলছিলো। ওই নম্বরে ফোন করা হলে রফিকুল ইসলাম নামের ব্যক্তি নিজেকে বাড়ির মালিক দাবি করে বলেন, রান্না ঘরসহ দুটি কক্ষের ভাড়া ৫ হাজার টাকা। কেসিসির জমি কিভাবে ভাড়া দিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই তো দিচ্ছে।
॥ দখল উদ্ধারে তৎপরতা নেই বহু বছর ॥
ষাটের দশক থেকেই সড়কের দুই পাশে জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ হতে থাকে। কখনোই এই কাজে বাধা দেয়নি সরকারি কোনো সংস্থা।
স্থানীয়রা জানান, সড়কের দখলদার ও ব্যবসায়ী সবাই স্থানীয়
৭টি ওয়ার্ডের ভোটার। বিআইডিসি সড়ক কেন্দ্রিক ভোটার রয়েছেন প্রায় ১৫-২০ হাজার। ভোটের রাজনীতির কারণে অতীতে কখনোই জমি দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কেসিসির বর্তমান মেয়র দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্বগ্রহণের পর খাল ও নদী উদ্ধার কার্যক্রম হাতে নেন। নদী দখল করে নির্মাণ করা বেশকিছু বহুতল ভবন গুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিআইডিসি সড়ক দখলমুক্ত করে প্রশস্তকরণের পরিকল্পনা করেছিলো কেসিসি। কিন্তু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
॥ মেয়র যা’ বললেন ॥
সার্বিক বিষয় নিয়ে সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক পূর্বাঞ্চলকে বলেন, বিআইডিসি সড়কের পাশে ৭ জন কাউন্সিলর রয়েছে। জমি উদ্ধারের বিষয়ে ব্যবসায়ীসহ সবার সঙ্গে আলোচনার জন্য তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কেসিসির ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর খুরশিদ আহমেদ টোনা পূর্বাঞ্চলকে বলেন, বিআইডিসি সড়কটি খুলনা-৩ আসনের মধ্যে পড়েছে। এজন্য আমরা আগে সাংসদ ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে কথা বলবো। তার মতামত নিয়ে এরপর অন্যদের সঙ্গে বসবো।