জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব
আসাদুজ্জামান বিকু: বিশ্বজুড়ে জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানো অনেকটাই কঠিন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস একটি ভয়ঙ্কর বার্তা দিয়েছে। আগামী ২০৫০ সালের ভিতরে দেশের আড়াই কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে। এখন থেকেই প্রস্তুতি না নিলে তার খেসারত ভয়াবহ হতে পারে বলে সংস্থাটি তাদের আলোচনায় প্রকাশ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে এমন আশংকা প্রকাশ করেছে উন্নয়ন সংস্থা ‘কারিতাস বাংলাদেশ’। জিআইজেড-এর ২০২৩ সালের গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। ২০০৮-২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশে ৪৭ লাখের বেশি মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে। শহরে আশ্রয় নেওয়া জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অভিবাসীদের মধ্যে ৫৭শতাংশই উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার।
এ বিষয়ে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, উপকূলীয় এলাকায় হাজার হাজার একর ফসলি জমিতে ঘের করা হচ্ছে। অন্যদিকে দুর্যোগ মোকাবেলায় টেকসই বাঁধ সঙ্কট। যদিও দুর্যোগকালে উপকূলের মানুষেরা নিজেরাই মানবঢাল হয়ে বাঁধ রক্ষাকরেন। তারা মন্ত্রণালয় কিংবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপেক্ষায় থাকেন না। দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে না পেরে তারা প্রতিনিয়ত নিজ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এসময় তিনি বলেন, দুর্যোগ কবলিত উপকূলের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংকট মোকাবেলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা রিপের্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল বলেন, ঘূর্ণিঝড়, অস্বাভাবিক জোয়ারের প্লাবন, লবণাক্ততা ও নদীভাঙনের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে বাধ্য হয়েই শহরমুখী হচ্ছেন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। তারা নিজ এলাকাছেড়ে শহরের বস্তিতে নিম্নমুখী জীবন-যাপন করতে যেয়ে পদে পদে ল্যঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। উদ্বাস্তু হবার কারণে তাদের জীবন-যাত্রার মান একেবারেই নিম্নমুখী। তাই উপকূলবাসীকে নিরাপদে রাখতে, জীবন-মান ধরে রাখতে হলে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
এসময় তিনি কারিতসের কর্মকাণ্ডের উদাহরণ তুলে ধরেন। বলেন, দুর্যোগ সাড়াদান, প্রশমণ ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে কারিতাস বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি গৃহ নির্মাণ, পয়নিঃষ্কাশ ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং কমিউনিটি অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে ৪ কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দিয়েছে।
এছাড়াও কারিতাস ৩ হাজার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং ১৪ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। শুধুমাত্র উপকূলীয় ও বন্যাপ্রবণ এলাকার দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি প্রশমনে বিভিন্ন জেলায় ৩২৯টি ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয় কেন্দগড়ে তুলেছে।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)সহ পরিবেশবাদী ১৭টি সংগঠন। গত ২৫ জুন মঙ্গলবার এক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে এই দাবি তুলে ধরা হয়। এ সময় কয়লা ও এলএনজিতে জাপানের বিনিয়োগ বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।
আলোচনায় অংশ নেন ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল। তিনি বলেন, গত জুন মাসে জাপানের কর্মপরিকল্পনা করা হয়। আমরা জানতে পেরেছি আবারো বাংলাদেশে অনেকগুলো এলএনজি টারমিনাল স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস বিস্তারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। জলবায়ুগত ঝুঁকির কারণে আমরা তা চাইনা। আমরা চাই, জাপান যেন নবায়নযোগ্য জালানী প্রকল্প স্থাপনের দিকে অগ্রসর হয়। সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি কৃষক নেতা বদরুল আলম বলেন, জাপান বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে, কিন্তু এর ফলে কি ক্ষতিহচ্ছে সেটি উপেক্ষিত থাকছে। বিশেষ করে এই বিনিয়োগের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব বাড়ছে। এতে উত্তরবঙ্গে খরা ও মরুকরণ হচ্ছে, ঋতুচক্রে পরিবর্তনে প্রভাব বাড়ছে। অথচ আমাদের দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রচুর সুযোগকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা, জাপান এই মানুষ ধ্বংস পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের বিনিয়োগ হবে জনকল্যাণমূখী ও জলবায়ু বান্ধব।
আলোচনায় অংশ নিয়ে, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে অসংখ্য মানুষ জীবীকা হারাচ্ছে, ফলে তারা বাধ্য হয়েই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আমাদের প্রত্যাশা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে কার্যকর ও জনহিতকর পদক্ষেপ নেবে।
চলনবিল রক্ষায় আমরার মেহনাজ মালা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে চলনবিলের অবস্থা একেবারেই সংকটপন্ন। কৃষকরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। খরা মৌসুমে মাটির ৫ ফুট নিচে পানি তোলার জন্য মেশিন স্থাপন করে পানি তুলতে হচ্ছে। আবার বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির আগেই পানিতে ফসলের ক্ষেত ডুবে যাচ্ছে।
ব্রাইটারসের সাইদুর রহমান সিয়াম বলেন, জাপানের গ্যাস প্রকল্প সম্প্রসারণের ফলে কার্বন নিঃসরণ আরো বেড়ে যাচ্ছে। জাপানের এলএনজি সম্প্রসারণের টার্গেট পূরণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করছে। এর মাধ্যমে জাপান আমাদেরকে বিভ্রান্ত করছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেইঞ্জ ট্রাস্টকে (বিসিসিটি) একটি দক্ষ,স্বয়ংসম্পূর্ণ ও যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ১০ বছর মেয়াদী স্ট্রাটেজিক প্ল্যান প্রণয়নসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন, ২০১০ সংশোধন ও নির্দেশিকা হালনাগাদ করে সময়োপযোগী করা হবে। তিনি জানান, সরকারি জমি বরাদ্দ পেলে বিসিসিটির জন্য নিজস্ব ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে, যা সংস্থার কাজকে গতিশীলতার পাশাপাশি স্থায়িত্ব দেবে।
উপদেষ্টা জানান, ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণা প্রকল্প সমূহের পেটেন্ট অধিকারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি, প্রকল্প কার্যক্রমের রিয়েল টাইম ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও তিনি জানান। পরিবেশ উপদেষ্টা ট্রাস্টের জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনবলকে আরও কার্যকর ও প্রভাবশালী করে গড়ে তুলতে হবে। তিনি জনকল্যাণে কাজ করার জন্য বিসিসিটির কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানান।