/ নগরীতে সাবেক যুবদল নেতা মাহবুব হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিন কিলার শনাক্ত

নগরীতে সাবেক যুবদল নেতা মাহবুব হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিন কিলার শনাক্ত

তদন্তে সাত কারণ খতিয়ে দেখছে পুলিশ

হাসান চৌধুরী, দৌলতপুর (খুলনা): খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর থানাধীন মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় নির্মমভাবে খুন হওয়া যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি মোঃ মাহবুবুর রহমান মোল্লা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত তিনজন অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাদেরকে শনাক্ত করা হলেও তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম-ঠিকানা বলছে না পুলিশ।


খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখন তাদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলেই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কেএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ রাশিদুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের জানান, আসামীদের গ্রেফতারে তৎপরতা চলছে। তবে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।


গত শুক্রবার দুপুর ১টা ৩০ মিনিটের দিকে নিজ বাড়ির সামনে মোটরসাইকেলযোগে এসে তিনজন অস্ত্রধারী প্রথমে মাহবুবুর রহমানকে গুলি করে ও পরে তার দু’পায়ের রগ কেটে নির্মমভাবে হত্যা করে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে রাতেই পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।


ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল শনিবার দুপুরে নিহতের পিতা মোঃ আঃ করিম মোল্লা বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় অজ্ঞাতনামাদের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-১২, তারিখ ১২/৭/২৫। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাহবুব হত্যাকাণ্ডের পেছনে সাতটি সম্ভাব্য কারণ নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২৪ সালের দুটি মামলার জের, দলীয় কোন্দল, স্থানীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি, মাদক সংশ্লিষ্টতা, চরমপন্থী সংযোগ, কুয়েট সংঘর্ষে সম্পৃক্ততা এবং বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ।


দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী জানান, হত্যার কারণ উদঘাটনে পুলিশের দু’টি ও ডিবির একটি টিম তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
নিহতের স্ত্রী এ্যারিন সুলতানা বলেন, আমার স্বামী সবার সঙ্গে ভদ্রভাবে চলতেন, কাউকে কোনো ক্ষতি করেননি। কিন্তু তারপরও ওরা আমার স্বামীকে বাঁচতে দিল না। তিনি আরও জানান, হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই মাহবুবকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল এবং একটি সশস্ত্র গ্রুপ সম্প্রতি বাসায় গিয়েও তাকে হুমকি দেয়। নিহত মাহবুবুর রহমানের দুই কন্যা রয়েছে। বড় মেয়ে জান্নাতুল (১১) চতুর্থ শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে মাওয়া (৯) দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।


নিহতের স্ত্রী অ্যারিন সুলতানা ঘটনার সময়কার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, একটি পালসার মোটরসাইকেল কয়েকবার রাস্তার এ মাথা থেকে ওমাথা ঘোরাঘুরি করে। পর পর কয়েকটি গুলির শব্দ শুনে আমি মনে করি কেউ বাজি ফুটাচ্ছে। সামনে বের হতেই দেখি ভ্যানচালক দৌড়ে গেটের ভেতরে ঢুকে চিৎকার করছে। দোতলা থেকে নিচে নেমে দেখি আমার স্বামীর রক্তমাখা নিথর দেহ পড়ে আছে। কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। খুনিরা চলে যাওয়ার সময়ও গালাগাল করতে করতে বলেছে আয় কে আসবি আয়।
নিহতের শ্বশুর আজাদ বেগ বাবু জানান, মাহবুব ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি অফিসে হামলার ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে মামলা করেন ৫২ জনের বিরুদ্ধে, যেখানে অজ্ঞাত আরো ১৫০-২০০ জনকেও অভিযুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই তার ওপর চাপ এবং হুমকি বাড়তে থাকে।


একই বছরের ২ অক্টোবর একটি রাজনৈতিক মারামারির ঘটনায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী জাকির হোসেন বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন। এই দুটি মামলার আসামিদের দিকেই সন্দেহের তীর। নিহতের শ্বশুর আজাদ বেগম বাবু জানান, এই মামলাগুলোই তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
২০২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েট (খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)-এর সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘর্ষে দলীয় নির্দেশে মাহবুব উপস্থিত ছিলেন। এ সময় কিছু স্থানীয় গ্রুপের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়। এই ঘটনাও তাকে টার্গেট করার অন্যতম কারণ হতে পারে বলে ধারণা পুলিশের। পাশাপাশি স্থানীয় কিছু গ্রুপের সঙ্গে প্রভাব বিস্তার নিয়েও দ্বন্দ্ব ছিল।
মাহবুব হত্যাকাণ্ডের পরদিন শনিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন কেএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবু সালেহ মোঃ রায়হান ও উত্তর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ তাজুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে হত্যার নেপথ্য কারণ জানার চেষ্টা করছেন।


দৌলতপুরে বিক্ষোভ মিছিল: দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে নৃশংসভাবে গুলি ও পায়ের রগ কেটে হত্যার ঘটনায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার ও খুলনায় অব্যাহত আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রতিবাদে গতকাল শনিবার বিকেলে দৌলতপুরে এই বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে বিক্ষোভ মিছিলটি শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে মীনাক্ষী হলের সামনে এসে শেষ হয়। মিছিলের সময় পুরো এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা খুনিদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চার স্লোগান দিতে থাকেন।
মিছিল শেষে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, খুলনায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই সন্ত্রাসীরা এমন বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সাহস পাচ্ছে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, খুলনায় অতীতে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও সেগুলোর বিচার হয়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা থাকছে না।
বক্তারা মাহবুব হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকেই দায়ী করে বলেন, যদি অবিলম্বে খুনিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় না আনা হয়, তাহলে আমরা আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব। তারা এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেন।