এম এ হাওলাদার ও মফিজুল ইসলাম জুম্মান: শতবছর ধরে চলে আসছে হাটটি। সপ্তাহে দু’দিন তথা শুক্র ও সোমবার বসে শেখপুরা হাট। মাছ ধরার জাল, চাইসহ স্থানীয় প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসই পাওয়া যায় এ হাটে। তবে সবচেয়ে বিশেষত্ব হচ্ছে নৌকার কেনাবেচা।
খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার শেখপুরা বাজার নামের এ হাটটি চার জেলার মানুষের চাহিদা পূরণ করে। সিংহভাগ নৌকা তৈরি হয় বাগেরহাটের চিতলমারীতে। সেখানকার ব্যাপারীরা প্রতি হাটে নৌকাগুলো সড়ক পথেই নিয়ে আসেন শেখপুরা বাজারে। তেরখাদা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও খুলনা, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ জেলার অনেক ক্রেতার শেখপুরা বাজারে আগমন ঘটে নৌকাকে কেন্দ্র করে। নৌকা কিনে নিয়ে যান ভ্যান, নছিমন বা টমটমযোগে। এভাবেই যুগের পর যুগ এ হাটে কেনাবেচা হয় নৌকা। এজন্যই তেরখাদা উপজেলা সদরের চেয়েও কদর বেশি শেখপুরা বাজারের।
হাট পরিদর্শনকালে কথা হয় সেখানকার ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে। তারা জানানেল এক সময় চিতলমারী থেকে পানিপথেই আনা হতো নৌকাগুলো। চিতলমারী কোদালিয়া বিল থেকে প্রথমে মোল্লাহাটের খুলনা-ঢাকা মহাসড়ক পার হয়ে পড়তো কেন্দুয়া বিলে। সেখান থেকে আবারো পানিপথে শেখপুরার পার্শ্ববর্তী শিয়ালী হয়ে আঠারোবেকি নদী দিয়ে নৌকাগুলো আনা হতো শেখপুরা বাজারে। তখন অবশ্য সময়ও বেশি লাগতো। শুক্রবারের হাট ধরতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে এসে ব্যাপারীরা নৌকা সাজিয়ে রাখতেন হাটে। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিল-খাল-নদী অনেকটা হারিয়ে গেছে। এজন্য এখন টমটম-নছিমনে(স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত যন্ত্রচালিত বাহন) করে নৌকাগুলো আনা হয় বাজারে।
সকালে একেকটি নছিমনে অন্তত: ১০/১২টি নৌকা একটির ওপর একটি সাজিয়ে আনা হয় চিতলমারী থেকে শেখপুরা। সকালে রওয়ানা দিয়ে বেলা ১০/১১টার মধ্যেই শেখপুরা হাটে এসে পৌঁছানো সম্ভব হয়। যেগুলো অবিক্রিত থাকে সেগুলো আবার নছিমন বা টমটমে করেই নিয়ে যান ব্যাপারীরা। অনেক সময় পরের হাটের জন্য রেখে দেওয়া হয় কারও জিম্মায়। তবে ডাঙ্গায় নৌকাগুলো রাখতে গিয়ে বৃষ্টি না হলে মাঝে-মধ্যে পানি ছিটিয়ে দিতে হয়। তা’ না হলে কাঠগুলো ফেটে যাওয়ার আশংকা থাকে।
নৌকার সাইজ ও ডিজাইনগুলো প্রায় একই ধরনের। তেরখাদা, নেবুদিয়া, শিয়ালী, চরকুলিয়া, কালিয়া, নড়াগাতি, গোপালগঞ্জ, মোল্লাহাট, রূপসা, দিঘলিয়াসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের অধিকাংশ কাজই করতে হয় নৌকাযোগে। বিশেষ করে মাছ ধরা, ফসল উত্তোলন করা, মানুষ পারাপারসহ নানান কাজে নৌকা ব্যবহৃত হয়। এজন্য নৌকার কদর বেশি ওই এলাকায়। যে কারনে যুগ যুগ ধরে নৌকার হাট চলে আসছে শেখপুরায়।
চিতলমারী থেকে শুক্রবার(১৮ জুলাই) ২৮টি নৌকা নিয়ে আসেন মোঃ অলিয়ার শেখ নামের এক ব্যাপারী। দুপুর ২টা নাগাদ বিক্রি হয় ১১টি। নৌকাগুলোর সাইজ ১০ হাত, ১২ হাত ১৩ হাত করে। প্রতিটি নৌকা বিক্রি করে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা লাভ হয়। সব নৌকা বিক্রি না হলে আবার ফেরত নিতে হয়। এতে কিছুটা খরচ বেড়ে যায়।
একই এলাকা থেকে আসেন হাসান। তার পিতা এবং দাদাও একই ব্যবসা করতেন। বংশ পরম্পরায় চলে আসা এ ব্যবসাটি তিনিও টিকিয়ে রাখছেন। বাড়িতে কাঠ কিনে মিস্ত্রি দিয়ে নৌকা তৈরি করেন তিনি। নৌকাগুলো মেহগনি কাঠের বলেও জানান ব্যাপারীরা।
নৌকা কিনতে আসা তেরখাদার মোকামপুরের ওমর আলী বিশ্বাস বলেন, কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয় নৌকা। বিলে যাতায়াতের জন্য তাদের প্রধান মাধ্যমই হলো এই নৌকা। এজন্য তিন হাজার ২০০ টাকায় তিনি একটি নৌকা কেনেন।
রূপসার বাঁধাল থেকে নৌকা কেনার জন্য গিয়েছিলেন মোঃ আঃ আউয়াল নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, মাছ ধরা, গরু পোষা তার পেশা। নৌকার প্রয়োজন মাছ ধরার কাজে। এছাড়া গরুর ঘাঁষ কাটার জন্যও নৌকার ব্যবহার হয়।
নৌকাগুলো হাট থেকে নিজ এলাকায় নেওয়ার জন্য সেখানে প্রতি হাটে হাজির থাকেন ভ্যান চালকরা। লিয়াকত নামের ভ্যান চালকের বাস তেরখাদার আজোগড়া এলাকায়। একটি নৌকা বহনের জন্য তাকে দেওয়া হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এছাড়া দূরের কোথাও গেলে আরও বেশি পান বলেও জানান তিনি। প্রতি হাটে ২/১টি ট্রিপ হয়। অনেক সময় একই এলাকায় ভ্যানযোগে একাধিক নৌকা নেওয়া হয়। তখন অবশ্য ভাড়া বেশি পান তিনি।
নৌকার ক্রেতাদের কাছ থেকে শতকরা ৬ টাকা হারে খাজনা নিয়ে থাকেন ইজারাদার। শেখপুরা হাটের ইজারাদার মোঃ এস্কেন্দার মোল্লা বলেন, প্রতি হাটে ৬০ থেকে ৭০টি নৌকা বিক্রি হয়। নৌকা প্রতি খাজনা আদায় করা হয় ৩০০/৪০০ টাকা করে। অনেক সময় কমও নেওয়া হয়। ক্ষেত্র বিশেষে গরীব মানুষ হলে খাজনা না দিয়েও কেউ কেউ চলে যান। বছরের তিন মাস বসে নৌকার হাট। জুন মাষের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে চলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। অর্থাৎ এক মৌসুমে প্রায় ৪০ কোটি টাকার নৌকা বিক্রি হয় শেখপুরা হাটে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, একেকটি নৌকার সাথে অন্তত: আট শ্রেণির লোকের কর্মসংস্থান হয়। প্রথমত: গাছ কেটে স’মিল পর্যন্ত নিতে যুক্ত থাকেন স্থানীয় দৈনিক মজুরি ভিত্তিক শ্রমিক। এরপর স’মিলের সাথে সংশ্লিষ্টরা এবং পরে কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরির কাজে যুক্ত হন মিস্ত্রি। মিস্ত্রি নৌকা তৈরির পর সেগুলো ব্যাপারীরা হাট পর্যন্ত নিতেও লেবার ও নছিমন-টমটম চালকদের যুক্ত করেন।বাজার থেকে ক্রেতার বাড়ি পর্যন্ত নৌকা নিতে যেমন ভ্যান, নছিমন, টমটম চালকরা যুক্ত হন আবার যিনি ব্যবহার করবেন তারও কর্মসংস্থান হয় ওই নৌকার মাধ্যমে। এছাড়া হাট ইজারাদারও আয় করেন নির্দিষ্ট হারে অর্থ। এর বাইরেও বাজারে নৌকা কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে আসা লোকদের খাবার দাবারের জন্যও দোকানদাররা নানান পণ্য সামগ্রী বিক্রির সুযোগ পান।