খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার বাজারগুলোতে ইলিশের আকাল
এম মুর্শেদ: ভারতে ইলিশ রপ্তানি,রপ্তানিকারকদের মজুদ,বিরুপ আবহাওয়ার কারনে ইলিশ মাছের দেখা নেই খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার বাজার গুলোতে।
বাংলার মানুষের প্রাণের মাছ ইলিশ স্বাদে অতুলনীয়। জনপ্রিয়তায় অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত অপরাজেয়। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এ মাছের জন্য মুখিয়ে থাকেন দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু ২০২৫ সালের ভরা মৌসুমেও খুলনার বাজারে ইলিশের দেখা মিলছে না বললেই চলে। যে অল্প কিছু মাছ আসছে,তার দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। এরই মধ্যে যোগ হয়েছে ভারতে ইলিশ রপ্তানী । ফলে ইলিশ এখন কেবল স্মৃতি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে অনেকের কাছে।
খুলনার নিউমার্কেট, সন্ধ্যা বাজার (ময়লাপোতা),মিস্ত্রিপাড়া বাজার, রুপসা পাইকারি আড়ৎ ও পাঁচ নম্বর (ভৈরব নদের) ঘাট, দৌলতপুর ও খালিশপুর ঘুরে দেখা গেছে গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশের দাম বেড়েছে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি ৯০০ থেকে ১,২০০ টাকা ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম কেজি ১,৫০০ থেকে ১,৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ৯০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের ২০০০ থেকে ২১০০ টাকায় । ১.২ থেকে ১.৩ কেজি ওজনের ২২০০ থেকে ২,৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত বছর খুলনায়, ভরা মৌসুমে ৫০০-৬০০ গ্রাম ইলিশের দাম ছিল ১,০০০ থেকে ১,২০০ টাকা, ৭০০-৮০০ গ্রাম ইলিশের দাম ছিল ১,৩০০ থেকে ১,৪০০ টাকা, এবং ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হত ১,৫০০ থেকে ১,৬৫০ টাকার মধ্যে।
দৌলতপুর বাজারের ক্রেতা আসলাম সরদার আক্ষেপ করে বলেন, ২১০০ টাকায় কেজি ইলিশ! কেনা তো দূরের কথা, দাম শোনারও সাহস পাই না। সন্ধ্যা (ময়লাপোতা) বাজারে রিকশাচালক জালাল হোসেন বলেন, সংসার চালানোই মুশকিল, সেখানে ইলিশ কিনে খাওয়ার টাকা কই?মিস্ত্রিপাড়া বাজারে গৃহিণী জুই আক্তার বলেন, ভরা মৌসুমেও ইলিশ নাগালের বাইরে। এখন শুধু ফেসবুকে ছবি দেখেই মন ভরাতে হয়।
খুলনার ভৈরব নদের পাড়ের ৫ নম্বর ঘাট ও রূপসা মাছঘাট দীর্ঘদিন ধরেই ইলিশ অবতরণের জন্য পরিচিত। মৌসুমে এ ঘাটগুলোতে নৌকা ভিড়ত। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত ইলিশের ঝিলমিল রূপ। কিন্তু এবার দৃশ্য একেবারেই উল্টো।
সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, সরবরাহ নেই বললেই চলে। ঘাটে ভিড় জমছে না,নেই মাছভরা ট্রলার। কেবল অল্প কিছু জাটকা ইলিশ চোখে পড়ে। স্থানীয় আড়ৎদার সাঈদ আলী,যিনি প্রায় ৭০ থেকে ৮০ বছরের পারিবারিক ব্যবসা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন,আমার বাবা-দাদার আমল থেকে ইলিশ মাছের ব্যবসা করছি। কখনো এমন আকাল পড়েনি। খুচরা ব্যবসায়ীরাও এখন অন্য মাছের দিকে ঝুঁকছেন।
খুলনার সরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এখন কার্যত নিষ্ক্রিয়। কমিশন বেশি হওয়ায় আড়ৎদাররা রূপসা আড়তের দিকে ঝুঁকছেন। এতে সরকারের রাজস্ব আদায়ও কমছে। তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ বছরে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০ হাজার কেজি কম ইলিশ এই কেন্দ্রে অবতরণ করেছে,যার ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও কমেছে।
এক আড়ৎদার জানান, সরকারি ঘাটে টোল ১ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু জেলেদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে আমাদের হাতে থাকে মাত্র ১ টাকা ৭৫ পয়সা। অন্য বাজারে এই টোল নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা সেখানেই ঝুঁকছেন।
কেন নেই ইলিশ এ কারন খুজতেই জানা গেল জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীর নাব্যতা সংকটে নদীর স্বাভাবিক স্রোত ও স্বচ্ছতা নষ্ট হওয়ায় ইলিশের অভিবাসন ব্যাহত হচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় মাছ ধরা বন্ধ থাকলেও বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় অনেকে নিয়ম ভাঙছেন। এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক সরবরাহে। সবচেয়ে বড় কারনটি মধ্যস্বত্বাভোগীদের দাপট। প্রান্তিক জেলেরা সরাসরি বাজারে যেতে না পেরে পাইকারি আড়তের ওপর নির্ভরশীল। হাতবদল বাড়ায় দামও বাড়ছে।
২০২৫ সালের ভরা মৌসুমে খুলনা ও দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলে ইলিশ আহরণে বৈরী আবহাওয়ার কারণে জেলেদের সাগরে যাওয়ার ওপর একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ১৩ বার সমুদ্র বন্দরগুলোকে সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে। এই সতর্ক সংকেতের কারণে প্রায়ই জেলেদের গভীর সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া, জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মোট ১৩ বার সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। প্রতিটি সতর্ক সংকেত সাধারণত ৩ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে, যার ফলে জেলেরা নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতি ইলিশ আহরণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
উল্লেখ্য, মে মাসে ২ বার, জুনে ৩ বার, জুলাইয়ে ৪ বার, আগস্টে ৪ বার এবং সেপ্টেম্বরের ২ সপ্তাহে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। এই ঘনঘন সতর্ক সংকেতের কারণে সাগরে ইলিশ আহরণে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটেছে।
রপসা পাইকারি আড়তে মংলা থেকে আসা এক জেলে আসাদ মোড়ল জানালেন, এবার বিরুপ আবহাওয়ার কারনে জেলেরা আশানুরুপ ইলিশ ধরতে পারেনি।
আড়ৎদার মোজাফফর হোসেন আশেক বলেন, আগে এক জালে ৫০থেকে ১০০ মণ ইলিশ পাওয়া যেত। এখন ৫ থেকে ৭ মণ পেতেও কষ্ট হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০সালে ৫.৫০ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হয়। ২০২০-২১ সালে উৎপাদন হয় ৫.৬৫ লাখ টন। ২০২১-২২সালে ৫.৬৭ লাখ টন, ২০২২-২৩ বেড়ে দাড়ায় ৫.৭১ লাখ টনে (সর্বোচ্চ)। কিন্তু গত ২০২৩-২৪ সালে ৪২ হাজার টন উৎপাদন কমে দাড়ায় ৫.২৯ লাখ টনে ।এটি গত পাচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু সংখ্যা নয়, বড় ইলিশও কমে গেছে, বাজারে বেশি আসছে ছোট জাটকা।
চলতি মৌসুমে ভারতীয় বাজারে ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন মেলে প্রায় ১,২০০ টন। ভারতীয় বাজারে রপ্তানির কারণে স্থানীয় বাজারে ইলিশের সরবরাহ কমেছে। প্রান্তিক জেলেদের উৎপাদিত মাছের বড় অংশ রপ্তানির জন্য সরাসরি চলে গেছে। ফলে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বাজারে মাছের অভাব তৈরি হয়েছে। আড়ৎদাররা কম সরবরাহের কারণে দাম বৃদ্ধি করেছেন, কারণ সাপ্লাই কমলে মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। সরবরাহ কমার সঙ্গে সঙ্গে দাম চড়া হয়েছে।
৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ইলিশের দাম কেজি ১,৩০০ থেকে ১,৪০০ টাকা পর্যন্ত, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বড় ওজনের মাছের দাম বেড়ে গিয়ে ২ কেজি ইলিশের জন্য ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে।
সাধারণ ক্রেতাদের জন্য ইলিশ এখন নাগালের বাইরে, যা সামাজিক অসন্তোষ এবং ক্রেতাদের হতাশা সৃষ্টি করেছে। বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়ায় দোকানগুলোতে ইলিশ মাছ রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
দাম বাড়লেও ক্রেতা না থাকায় কিছু দোকান মাল বিক্রি করতে পারছে না, ফলে লোকসান হচ্ছে। আড়ৎদারদেরও লাভের মার্জিন কমেছে, কারণ কম সরবরাহ ও বাজারের অনিশ্চয়তার কারণে ক্রয়-বিক্রয় চক্র ব্যাহত হচ্ছে।
কিছু প্রান্তিক জেলে রপ্তানির জন্য মাছ সরবরাহে অংশগ্রহণ করছেন। স্থানীয় বাজারে বিক্রির সুযোগ কমে যাওয়ায় ছোট জেলেদের আয় হ্রাস পাচ্ছে।
জেলেরা বড় বাজার ও পাইকারি চেইনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, যা তাদের স্বতন্ত্র বিক্রির সুযোগ কমাচ্ছে।
রপ্তানির ফলে বড় আড়তে মাছ মজুদ হচ্ছে। স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীরা ছোট পরিমাণে মাছ কিনতে পারছেন না। বাজারে হাতবদল বেড়ে যাওয়ায় দাম স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারতে ইলিশ রপ্তানি খুলনা ও দেশের বাজারে সরবরাহ কমানো, দাম বৃদ্ধি, খুচরা ব্যবসায়ীদের ক্ষতি, জেলেদের আয় হ্রাস এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া সব মিলিয়ে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
নিউমার্কেট বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আফজাল শেখ বলেন, এখনকার দামে দোকানে মাছ তোলা ভীষণ কঠিন। সারাদিন বসেও কয়েকটা মাছ বিক্রি হয়। খালিশপুর বাজারের ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান বলেন, অনেক সময় ইলিশ কয়েক দিন পড়ে থাকে, তখন বাধ্য হয়ে কেনা দামে বা তারও কমে বিক্রি করতে হয়।
ইলিশ শুধু একটি মাছ নয় এটি বাঙালির সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু সরবরাহ ঘাটতি,রপ্তানি নীতি, আবহাওয়া প্রতিকূলতা ও বাজারের নিয়ন্ত্রণহীনতায় বাংলাদেশে ইলিশ ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
যে ইলিশ একসময় উৎসবের প্রতীক ছিল, তা এখন সাধারণ মানুষের জন্য কেবল গল্প কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবিতেই সীমাবদ্ধ।মাছের রাজা বাঁচাতে হলে সরকার, ব্যবসায়ী, জেলে ও ভোক্তা সবাইকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে