/ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নই বদলে দিতে পারে খুলনার পর্যটন শিল্পকে

পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নই বদলে দিতে পারে খুলনার পর্যটন শিল্পকে

সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটনের রয়েছে অপার সম্ভাবনা

এম এ হাওলাদার: খুলনা মহানগরীর মুজগুন্নীতে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পাঁচ একর জমি আজ অবহেলায় পড়ে আছে। চারপাশে আগাছায় ভরা জায়গা, কোথাও স্তুপ করা ইট আর ভাঙাচোরা দেওয়ালের অবশেষ। অথচ স্থানীয়দের কাছে একসময় এটি ছিল ‘স্বপ্নের জমি’। এখানে হওয়ার কথা ছিল আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, প্রশিক্ষণকেন্দ্র- যা খুলনার পর্যটন শিল্পে আনবে নতুন ভোর। কিন্তু সেই ভোর আর আসেনি।

বছর যায়, সরকার বদলায়, পরিকল্পনা কাগজে আঁকা হয়- কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না। এদিকে একই সময়ে সুন্দরবনঘেঁষা দাকোপ, কয়রা, মোংলা ও শ্যামনগরে উদ্যোক্তারা সীমিত মূলধন নিয়ে ইকো কটেজ ও রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন। সেখানে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়লেও সরকারি উদ্যোগ রয়ে গেছে কাগজে-কলমে। আজ (২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব পর্যটন দিবসে খুলনার বাস্তবতাই যেন সেই অচলাবস্থার প্রতিচ্ছবি। অথচ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার খুলনা- যা হতে পারত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু।

দাকোপের নলিয়ান হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ শেষে পর্যটকরা চাইলে একই দিনে খুলনা শহরে ফিরে আসতে পারতেন। আবার যারা রাত কাটাতে চান, তাঁদের জন্য নদীর ধারে ইকো কটেজ বা মানসম্মত রিসোর্ট থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে দুর্বল সড়ক যোগাযোগ, ভাঙাচোরা সেতু আর ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো সব আকাঙ্খায় টান দেয়।

দাকোপের জঙ্গলবাড়ি ইকো কটেজ মালিক ও রিসোর্ট ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া হোসেন শাওন বলেন, “আমরা সাধ্যমতো বিনিয়োগ করেছি, বিদেশি পর্যটকও আসে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ ও সরকারি স্বীকৃতির অভাবে সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। সরকার যদি পাশে দাঁড়াত, এই অঞ্চল পুরোপুরি বদলে যেত।” তাঁর তথ্যমতে, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় ইতিমধ্যেই প্রায় ২৩টি ইকো রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। কিন্তু বন বিভাগ ও পরিবেশ দপ্তরের দ্ব›েদ্বর কারণে উদ্যোক্তারা স্বীকৃতি পাচ্ছেন না।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সড়ক উন্নয়ন হলে শুধু পর্যটন নয়, তাঁদের জীবনও বদলে যাবে। সহজে চিকিৎসা পাওয়া, কাজের সুযোগ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু প্রতিশ্রæতির কথা শোনেন তাঁরা বারবার, কাজের বাস্তবতা মেলে না।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা, পরিসংখ্যান ও প্রশিক্ষণ) মো. জিয়উল হক হাওলাদার জানান, “মুজগুন্নীর জমিতে পিপিপির আওতায় প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে হোটেল ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আশা করছি দ্রæত অগ্রগতি আসবে।”

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, “দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন খাত নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা জরুরি। সুন্দরবনকেন্দ্রিক উদ্যোগে মুজগুন্নীতে পর্যটন করপোরেশনের জমিতে স্থাপনা তৈরি হলে স্থানীয়ভাবে তদারকি সম্ভব হবে। ইউএসএআইডি’র সহায়তায় ইতিমধ্যে ২০ বছরের জন্য একটি ইকোট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েছে। বন বিভাগের অনুমোদন পেলেই পর্যটন শিল্পে গতি আসবে।”

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন (টোয়াস)-এর সাধারণ সম্পাদক এম. নাজমুল আযম ডেভিড বলেন, “পর্যটকদের সুবিধার্থে সুন্দরবনের সিঁড়িগুলো পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা দরকার। পাশাপাশি খুলনা শহর থেকে বড় জাহাজে ওঠা-নামার জন্য যে পল্টুন দেওয়া হয়েছিল, সেটি এখনও কার্যকর হয়নি। বরং সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ সিঁড়ি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এগুলো সমাধান হলে পর্যটকদের অভিজ্ঞতা অনেক উন্নত হবে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিত সড়ক উন্নয়ন, সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বে হোটেল-মোটেল নির্মাণ এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন নীতিমালা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিলে খুলনা হয়ে উঠতে পারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘ট্যুরিজম হাব’।