/ খুলনার সরকারি হাসপাতালগুলো যেন রোগী ধরার ফাঁদে পরিণত

খুলনার সরকারি হাসপাতালগুলো যেন রোগী ধরার ফাঁদে পরিণত

চিকিৎসার নামে চলছে বাণিজ্য

এম. মুর্শেদ: অসুস্থ মানুষের শেষ আশ্রয় সরকারি হাসপাতাল। ভরসা থাকে কম খরচে সঠিক চিকিৎসা ও দক্ষ চিকিৎসকের ওপর। কিন্তু খুলনায় সেই আশ্রয়স্থলই পরিণত হয়েছে প্রতারণার কেন্দ্রে। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতাল ও খুলনা জেনারেল হাসপাতাল এই তিন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই গড়ে উঠেছে অদৃশ্য এক দালাল সিন্ডিকেট। প্রতিদিন শত শত রোগীকে বাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আশপাশের বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।

সূত্র বলছে, খুমেক হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা মাত্র ৫০০। অথচ প্রতিদিনই ভর্তি থাকেন তিনগুণের বেশি রোগী। গত শনিবার রোগীর সংখ্যা ছিল দেড় হাজারেরও বেশী রোগী। জায়গা না থাকায় করিডোর, বারান্দা ও মেঝেতে শুয়ে থাকতে হচ্ছে বহু মানুষকে। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় দালালচক্র। ভোর থেকেই হাসপাতালের বিভিন্ন প্রবেশপথ ও ওয়ার্ডে অবস্থান নেয় তারা। রোগীর স্বজনদের টার্গেট করে নানা প্রলোভন দেখানো হয়। এখানে সেবা পাবেন না, বাইরে ভালো ডাক্তার আছে, কম টাকায় পরীক্ষাহবে এমন যুক্তি দেখিয়ে রোগীদের সরকারি হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অনেক সময় ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনের পাশাপাশি একটি আলাদা কাগজ ধরিয়ে দেন। তাতে লেখা থাকে মোবাইল নম্বর। বলা হয়, এই নম্বরে ফোন করলে দ্রুত পরীক্ষা হয়ে যাবে। কিন্তু ফোন করলে হাজির হয় এক বহিরাগত। হাতে ব্যাগ, সিরিঞ্জ, তুলা। তিনি রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে, টাকা নেন এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে যান বেডে। রোগীরা ভেবে নেন, এটি সরকারি হাসপাতালের প্রক্রিয়া। পরে দেখা যায়, রিপোর্টে লেখা থাকে বাইরের কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম।

সাতক্ষীরার কৃষক আসাবুর বলেন, ডাক্তার হাতে একটা কাগজ দিলেন। নম্বরে ফোন করলে একজন এসে রক্ত নিয়ে গেল। আমরা ভেবেছিলাম সরকারি হাসপাতালেরই লোক। পরে দেখি রিপোর্টে বেসরকারি সেন্টারের নাম। যশোরের গৃহিণী হাফিজা খাতুন বলেন, গরিবের হাসপাতালে এসেছিলাম কম খরচে চিকিৎসা নেব বলে। কিন্তু এখানে তো আরও বেশি খরচ হলো। কমিশনের ফাঁদে পড়ে আমরা নাজেহাল।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিদিনের এই লেনদেনের একটি নির্দিষ্ট অংশ কমিশন হিসেবে পৌঁছে যায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা কর্মচারীর কাছে। এ কারণেই দালালদের হাসপাতালে অবাধ চলাফেরা বাধাগ্রস্ত হয় না।

একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারীও স্বীকার করেছেন, আমাদেও সঙ্গে কিছু ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর যোগসাজশ আছে। তারা রোগী পাঠান, আমরা কমিশন দেই। এভাবেই ব্যবসা চলে। শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, দালালরা শুধু সরকারি নয়, প্রায় সব বেসরকারি ক্লিনিকের সঙ্গেই চুক্তিবদ্ধ। একজন দালাল রোগীকে ক্লিনিকে নিয়ে গেলে টেস্ট ফি থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ পায়। যেমন ২০০ টাকার টেস্টে ৫০ টাকা, ৩০০টাকার টেস্টে ৮০ টাকা কমিশন।

গত দুই বছরে জেলা প্রশাসন, র‌্যাব, পুলিশ, দুদক ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের ধারাবাহিক অভিযানে বহুবার এ চক্রের সদস্যরা ধরা পড়েছে। প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৪০টির বেশি অভিযান চালানো হয়েছে। এসব অভিযানে মোট ১৭০ জনের বেশি দালালকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ তাৎক্ষণিক কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, আবার অনেককে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে ৮৫ জন এবং ২০২৪ সালে অন্তত ৬০ জন দালাল আটক হয়। ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসেই ২৫ জনের বেশি দালাল ধরা পড়ে। অভিযান চালিয়ে দুদক সম্প্রতি কয়েকজন দালালকে আটক করে মোবাইল কোর্টে এক মাসের কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু তাতে মূল চক্রের কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়েনি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, শুধু খুলনা মেডিকেলের আশপাশেই নারী পুরুষ মিলে অন্তত ৩৫০ জন দালাল সক্রিয়। খুমেক হাসপাতাল এলাকায় বর্তমানে শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। অভিযোগ আছে, অনেকগুলো চলছে নকল কাগজপত্রে। এমনকি বহু ক্লিনিকে নির্ধারিত ডাক্তার বা নার্স নেই। নিয়ম অনুযায়ী ১০ শয্যার ক্লিনিকে তিনজন ডাক্তার, দুইজন নার্স ও তিনজন সুইপার থাকার কথা। অথচ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক ডাক্তার দিয়ে কাজ চালানো হয়। রোগীর অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসার সময় ডাক্তার হাজির না থাকায় অনেক সময় ঘটে বিপত্তি।

বাগেরহাটের আলমগীর হোসেন স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন খুমেক হাসপাতালে। আউটডোরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। ঠিক তখনই এক নারী তাকে ভালো চিকিৎসকের আশ্বাস দিয়ে পাশের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে কয়েকটি পরীক্ষা করিয়ে ৪ হাজার টাকা বিল করা হয়। পরে অন্য এক সরকারি ডাক্তার জানান, এসব পরীক্ষার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এ ঘটনায় শুধু অর্থই নয়, সময়ও নষ্ট হয়েছে; তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থারও অবনতি হয়েছে। নগরীর সুলতানা আক্তার বলেন,প্রথমবার খুলনা মেডিকেলে এসেছি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক নারী আমাকে ভালো ডাক্তার দেখানোর কথা বলে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এড.বাবুল হাওলাদার বলেন, যেখানে গরিব মানুষ চিকিৎসার শেষ আশ্রয় খুঁজতে আসে, সেই জায়গাটাই যদি দালালচক্র দখল করে নেয়, তবে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর আস্থা টিকবে কীভাবে ? তিনি আরও বলেন, দালালচক্র ও অনুমোদনহীন ক্লিনিক বন্ধ করতে হলে হাসপাতালের প্রবেশ পথে কঠোর নিরাপত্তা ও সিসিটিভি নজরদারি বাড়াতে হবে, বহিরাগত প্রবেশ সীমিত করতে হবে, কমিশন বাণিজ্যে জড়িত চিকিৎসক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে দ্রুত ও মানসম্মত পরীক্ষা নিশ্চিতসহ অনুমোদনহীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করতে হবে।

নাগরিক নেতা সরদার আবু তাহেরের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালগুলো রোগী ধরার ফাদে পরিণত হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ বাধ্য হচ্ছে মহাখরচের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে।

খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. আইনুল ইসলাম বলেন, আমি যোগদানের পর এ বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছি । দালালদের সমুলে উচ্ছেদ ও বিভিন্ন অনিয়ম দুর করতে বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করতে যাচ্ছি। আমি প্রশাসন, ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করেছি। খুব শীঘ্রই সেবা প্রত্যাশীরা এর ফল পাবে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রধান ভরসা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। কিন্তু এই হাসপাতালে যদি দালাল সিন্ডিকেট রোগী ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়, তবে সাধারণ মানুষের আস্থা কোথায় দাঁড়াবে ? বর্তমানে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে গভীর সংকটে পড়েছে, খুলনার ঘটনাই তার প্রতিচ্ছবি। অসহায় রোগীরা চিকিৎসা নয়, হচ্ছে প্রতারিত। আর এই কমিশন বাণিজ্যের ক্যানসার বন্ধ না হলে সরকারি হাসপাতালগুলো ধীরে ধীরে মানুষের কাছে আরও অবিশ্বাস্য হয়ে উঠবে।