/ সবকিছুর দাম আকাশচুম্বী

সবকিছুর দাম আকাশচুম্বী

মরিচ থেকে চাল

স্টাফ রিপোর্টার: শনিবার বিকেল। খুলনার ময়লাপোতা মোড়ের কেসিসি সন্ধ্যা বাজারে মানুষের ভিড়। হাতে থলে, চোখে দীর্ঘশ্বাস। গৃহিণী রুবিনা আক্তার থমকে দাঁড়িয়ে বেগুনের দাম জিজ্ঞেস করলেন। বিক্রেতা বললেন, গোল বেগুন ১৪০ টাকা কেজি, লম্বা বেগুন ১০০ টাকা। শুনে রুবিনা ফিসফিস করে বললেন, এই দামে আমি আর কয়দিন সংসার চালাব ? তারপর ছোট্ট একটি বেগুন কিনে ফিরে গেলেন। এমন দৃশ্য এখন খুলনার প্রতিটি বাজারের। ক্রেতাদের মনে একটাই প্রশ্ন আমাদের বাঁচার উপায় কী ?

সবচেয়ে বেশি আলোচনায় কাঁচা মরিচ। রান্নাঘরে অপরিহার্য এই উপকরণ আজ যেন সোনার চেয়েও দামি। এক সপ্তাহ আগেও মরিচের দাম ছিল কেজি প্রতি ২০০ থেকে ২২০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা। পাইকারি বাজারে পাঁচ কেজি মরিচ কিনতে হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকায়।

গৃহিণী সালমা খাতুন কষ্টের সঙ্গে বলেন, মরিচ ছাড়া রান্না জমে না। কিন্তু এই দামে মরিচ কিনলে বাচ্চাদের জন্য অন্য কিছু কেনা সম্ভব নয়। এখন রান্নায় মরিচের ব্যবহার অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছি। বিক্রেতারা অবশ্য দোষ দিচ্ছেন প্রকৃতিকে। তাদের দাবি, বৃষ্টিতে মরিচের ক্ষেত নষ্ট হয়েছে, আবার ভারত থেকেও আমদানি বন্ধ। তাই সরবরাহে ঘাটতি, আর দাম বেড়ে আকাশছোঁয়া।

শুধু মরিচ নয়, প্রতিটি সবজিই এখন যেন অমূল্য সম্পদ। উচ্ছে ৮০ টাকা, টমেটো ১১০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি, গাজর ১২০ টাকা কেজি, বরবটি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ঢেঁড়শ ও ঝিঙে ৬০ টাকা,ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতিটি ৯০ থেকে ১০০ টাকা, আলু ২০ টাকা কেজি। শীতের আগাম সবজি শিমের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মাত্র এক সপ্তাহে ৭০ থেকে ৮০ টাকা বেড়ে এখন কেজি প্রতি ২৪০ টাকা। শাকের দামও অনুরূপ। লালশাক প্রতি আঁটি ২৫ থেকে ৩০ টাকা, পুঁইশাক ৪০ থেকে ৫০ টাকা, লাউ ও কুমড়া শাক ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে যে শাক ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের আশ্রয়, সেটাও এখন বিলাসী খাদ্যে পরিণত হয়েছে।

দিনমজুর শ্রবণ দাস বলেন, আমরা দিনে ৫০০ টাকা রোজগার করি। তিন বেলা খেতে গেলে পরিবারের সবাইকে মেপে খেতে হয়। এখন তো সবজির বাজারে গেলে মনে হয় খালি হাতে ফিরে আসতে হবে।

যেখানে সবজি কিনতে দিশেহারা হতে হচ্ছে, সেখানে চাল, ডাল আর তেলের দামও প্রতি সপ্তাহে চড়া হচ্ছে। স্বর্ণা চাল এখন ৫৫ টাকা কেজি, এক মাস আগেও ছিল ৫২ টাকা। মিনিকেট চাল (ভালো মান) ৭৫ টাকা কেজি। বাসমতি চাল ৯০ টাকা কেজি, যা কয়েকদিন আগেও ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। ডালের বাজারেও একই চিত্র। মোটা মশুর ডাল কেজি প্রতি ১০০ টাকা,সরু মশুর ১৫০ টাকা। অথচ মাসখানেক আগে আমদানীকৃত মোটা মসুর ডাল ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। তেলের দামও লাগামছাড়া। লিটার প্রতি বোতলজাত সয়াবিন এখন ১৮৩ টাকা, আর লুজ সয়াবিন ১৯৫ টাকা। পাঁচ লিটার বোতল কিনতে লাগছে ৯১৫ টাকা। রোজগার সীমিত পরিবারের জন্য এই দাম মানে মাসজুড়ে পেটের ভাতই অনিশ্চিত।

দেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৭৫ টাকা,দেশি রসুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা। চায়না রসুন ১৬০থেকে ১৭০ টাকা কেজি। তুলনায় দাম স্থিতিশীল হলেও সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এগুলোর মূল্যও মানুষের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
বাজারে যাকে জিজ্ঞেস করবেন,সবার অভিযোগ একই অসহনীয় দাম। দৌলতপুর বাজারের ক্রেতা চাকুরীজীবী আসাদ জানালেন, ডাল, তেল, চাল, সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। পরিবার চালানো এখন যুদ্ধের মতো। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করা দরকার।

অন্যদিকে সফিকুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, সরবরাহ আছে, কিন্তু দাম অস্বাভাবিক। মরিচের দাম একলাফে চল্লিশ টাকা বেড়ে গেছে। এটা তো স্বাভাবিক না। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দাম কমবে না।
বিক্রেতারা অবশ্য নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তাদের কথায়, পাইকারি বাজার থেকেই সবকিছু বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। খুলনার দৌলতপুর বাজারের সবজি বিক্রেতা মুজিবর আফসোস করে বললেন, আমরা তো চাই সস্তায় বিক্রি করতে। কিন্তু পাইকারি বাজারে যদি মরিচ ১৩০০ টাকা পাল্লা হয়, আমরা ১০০০ টাকায় কীভাবে বিক্রি করব? আমাদেরও সংসার আছে।

এই মূল্যবৃদ্ধির সবচেয়ে ভয়ংকর প্রভাব পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে। রিকশাচালক, দিনমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিক যাদের আয় সিমীত, তাদের সংসারে অভাব এখন নিত্যসঙ্গী।

রিকশাচালক নূর আলম কাঁপা কণ্ঠে বললেন, আগে ১০০ টাকায় চাল, ডাল, সবজি কিছুটা হলেও হতো। এখন ওই টাকায় শুধু আধা কেজি ডাল আর একটু আলু হয়। বাচ্চাদের জন্য মাছ কিনতে পারি না। মাঝে মাঝে খালি ভাত খেয়ে থাকতে হয়। মা জাহানারা বেগমের চোখ ভিজে আসে বলতে গিয়ে, ছেলেমেয়েরা মাংস খেতে চায়। আমি বুঝিয়ে বলি, এখন বাজারে মাংসের দাম আকাশচুম্বী। তখন ওরা চুপচাপ থাকে। কিন্তু একজন মা হিসেবে আমার বুক ফেটে যায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ অবস্থা কেবল আবহাওয়ার কারণে নয়। বাজারে অরাজকতা, সিন্ডিকেট ও তদারকির অভাবও অন্যতম কারণ।
নাগরিক নেতা এড. বাবুল হাওলাদার বলেন, প্রতিবার বৃষ্টির অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু আবহাওয়া স্বাভাবিক হলেও আর দাম কমে না। সরকারকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।

বাজারের এই আগুনঝরা দাম এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও মানবিক সংকটও তৈরি করেছে। অনেক পরিবার এখন তিন বেলার খাবার থেকে এক বেলা কমিয়ে দিয়েছে। শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার কেনা অসম্ভব হয়ে উঠছে। ভাড়া,শিক্ষা খরচ,চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবার ঋণের ফাঁদে পড়ছে। বস্তুত,বাজারের এই অস্থিরতা মানুষকে শুধু ক্ষুধার কষ্টেই ফেলছে না, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করছে।

চাল, ডাল, তেল, সবজি সবকিছুর দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবন এখন টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত। বাজারে গেলে আর আনন্দ নেই, আছে ভয় আর হতাশা। প্রশ্ন একটাই কবে আসবে স্বস্তি?