এম. মুর্শেদঃ সুন্দরবনের নদীতে প্রতিদিন যেমন জোয়ার ভাটা আসে, তেমনি আসে জীবন আর মৃত্যুর খেলা। সেই খেলায় এবার হেরে গেলেন জেলে সুব্রত মণ্ডল (৩২)। এক হিংস্র কুমিরের আক্রমণে প্রাণ হারানো এই জেলের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে খুলনার দাকোপ উপজেলার সুন্দরবন ঘেঁষা ঢাংমারী গ্রামে।
দুর্গা পুজার নবমীর দিন ভোরে সুব্রত মণ্ডল ও তাঁর সহযাত্রী জুয়েল সরদার,স্বপন,সোহেল ও জয় সরকার মোট পাঁচজন ছোট একটি সোল নৌকায় করে সুন্দরবনের নদীতে নামেন কাঁকড়া ধরতে। সকালটা ছিল স্বাভাবিক, হাসি আড্ডায় ভরা। কেউ জানত না, সেটিই হবে সুব্রতের জীবনের শেষ নদীযাত্রা।
দিনভর কাঁকড়া ধরার পর বিকেলে তারা ফিরছিলেন। নৌকায় চারজন উঠলেও সুব্রত তখনও হাসিমুখে বললেন,তোরা আগে উঠ, আমি পরে উঠছি। ঠিক সেই মুহূর্তে নিচের কালো পানির বুক চিরে উঠে আসে এক বিশাল কুমির। এক নিমিষে সুব্রতের বাম পা ধরে টেনে নেয় নদীর গহীনে। সহযাত্রী জুয়েল সরদার তখনই হাত বাড়িয়ে ধরেন সুব্রতের বাহু। স্বপন ও সোহেল মিলে প্রাণপণ চেষ্টা করেন তাঁকে টেনে তুলতে, কিন্তু কুমিরের টানে হাত ফসকে যায়। সোহেল সাহস করে পানিতে লাফ দেন, কুমিরের মাথায় উঠে আঘাত করতে থাকেন। কিন্তু নদীর স্রোত আর কুমিরের শক্তি মানুষদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
প্রায় ২০ মিনিট পর ভেসে ওঠে সুব্রতের নিথর দেহ। সন্ধ্যায় বনবিভাগ ও স্থানীয়রা মিলে লাশ উদ্ধার করে। তাঁর শরীরের ক্ষত, পায়ের ছিন্ন অংশ, আর মুখের আতঙ্ক জমে থাকা চিহ্ন যেন বলে দেয় জীবিকার জন্য লড়াই করতে করতে সুন্দরবনের নদীতেই হারিয়ে যায় এই মানুষগুলো।
সুব্রত ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। বাড়িতে তাঁর অন্ধ বাবা, চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মুন্নী ও দুই ছোট ভাই। এখন সেই ঘরে শুধু নীরবতা। বাতাসে মিশে আছে কান্নার শব্দ। মুন্নী এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না সুব্রত আর ফিরবেন না। চোখ ফোলা, মুখ শুকনো। পাশে পড়ে আছে স্বামীর একটি পুরোনো জামা যা এখন তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা।
তিনি বলেন, সেদিন সকালে অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্না করছিলাম। বলেছিলাম, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, খাওয়া তৈরি। দুপুরে শুনলাম কুমিরে নিয়ে গেছে। ভেবেছিলাম ভুল খবর। কিন্তু লাশ দেখেই বুঝলাম, আমার সব শেষ।
অন্ধ বাবা কুমুদ মণ্ডল একসময় দিনমজুর ছিলেন। ছানি পড়ে ধীরে ধীরে হারিয়েছেন দুই চোখের দৃষ্টি। ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ তিনি। আমি কিছুই দেখি না, এখন শুনতেও ভয় পাই… কুমিরে আমার ছেলেকে খেয়েছে, থেমে থেমে বলেন কুমুদ। পাশে মা বাবনী মণ্ডল নিঃশব্দে কাঁদেন।
বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ছোট ভাই দেবপ্রসাদ (ঝন্টু) বলেন, ভাই বলেছিল, বিদেশ যাওয়ার দরকার নাই আমরা একসাথে সংসার সামলাবো। এখন ভাই নাই, আমি আর কোথাও যাব না।
ঢাংমারী গ্রামের পুরুষদের অধিকাংশই নির্ভর করেন সুন্দরবনের ওপর। কাঁকড়া ধরা, গোলপাতা কাটা বা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ সবই জীবনঝুঁকিপূর্ণ পেশা। গ্রামের প্রবীণ অমল হালদার বলেন, আমাদের ছেলেরা পেটের দায়ে বনে যায়। কে ফিরবে, কে ফিরবে আর ফিরবে না তা কেউ জানে না। কিন্তু না গেলে তো সংসার চলে না। গত বছর একই গ্রামের মোশাররফ গাজীও কুমিরের আক্রমণে প্রাণ হারান।
এমন দুর্ঘটনা এখানকার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। বাঘ, কুমির আর ঝড় তিন বিপদের সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই করে এই মানুষগুলো।
সাংবাদিক মুহসীন-উল হাকিম বলেন, পাস নিয়ে বনে গিয়ে কুমিরের আক্রমণে মারা গেলে সরকারি ক্ষতিপূরণ তিন লাখ টাকা। কিন্তু কাগজপত্রের জটিলতায় অনেক পরিবার সেই টাকা পায় না। সুব্রতের পরিবারেরও সেই আশঙ্কা আছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন,সুব্রতের পরিবারের সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। তদন্ত শেষে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হবে।
মুন্নী এখন গ্রামের অন্য নারীদের সহায়তায় দিন পার করছেন। বাচ্চা জন্ম নেবে, কিন্তু তার বাবা থাকবে না, বলতে বলতে তাঁর গলা ভারী হয়ে আসে। পাশের এক প্রতিবেশী নারী বলেন, ওর পেটে থাকা সন্তানই এখন আমাদের সবার আশা।ঢাংমারীর বাতাসে এখনো সুব্রতের নাম উঠলেই থেমে যায় কথাবার্তা। নদীর পাড়ে মৃদু বাতাস বইছে, তাতে মিশে আছে অন্ধ কুমুদের নিঃশব্দ কান্না। সুব্রতের ব্যবহৃত শার্টটি এখনো ঝুলছে ঘরের কোণে স্মৃতির নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে।সুন্দরবনের নদী আবারও বয়ে চলেছে আগের মতো,কিন্তু তার ঢেউয়ে মিশে আছে সুব্রতের শেষ চিৎকার। এ যেন এক অনন্ত সত্য এখানে মানুষ বাঁচে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েই।