/ নগরীতে টার্গেট কিলিং ও গুপ্ত হত্যার ঘটনায় উদ্বিগ্ন মানুষ

নগরীতে টার্গেট কিলিং ও গুপ্ত হত্যার ঘটনায় উদ্বিগ্ন মানুষ

খালিশপুরে শ্যালিকার হাতে দুলাভাই খুন

স্টাফ রিপোর্টার: খুলনা মহানগরীতে ভয়াবহভাবে খুনোখুনির ঘটনা বাড়ছে। নিয়মিত বিরতিতে বাড়ছে নিহতের মিছিল। এই মাসের গেল ১০দিনে নগরীতে খুনসহ চারটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। মাদক বিকিকিনি, নারী সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভক্তি এবং কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য খুনের ঘটনার অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছে পুলিশ। রয়েছে পারিবারিক কলহের জেরে খুনের ঘটনাও। এছাড়া টার্গেট কিলিং ও গুপ্ত হত্যার ঘটনায়ও চরম উদ্বেগ নগরবাসীর মধ্যে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর খালিশপুর থানার সবুজ খান (৫৫) নামে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সকালে খালিশপুর হাউজিং বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় মাদক ও মামলাবাজ একটি গ্রুপের বিরুদ্ধে গত ৫ অক্টোবর খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সবুজ ও তার পরিবারের সদস্যরা। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাই গতকাল সকালে বাজারে যাওয়ার সময় বক্কর বস্তি এলাকায় ৬-৭ জন কুপিয়ে হত্যা করে সবুজ খানকে। নিহত সবুজ খান বায়তুল ফালাহ এলাকায় ভাঙারির ব্যবসা করতেন।

ঘটনার পর পুলিশ নিহত সবুজ খানের শ্যালিকা নাজমাকে গ্রেফতার করে। সন্ধ্যায় নিহতের স্ত্রী শাহিনুর বাদী হয়ে খালিশপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। বাকী আসামীদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে বলে খালিশপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী জানিয়েছেন।

এর তিনদিন আগে নগরীর কাস্টমস ঘাট এলাকায় ইমরান মুন্সি নামের এক যুবকের মাথায় গুলি করে কুন করে সন্ত্রাসীরা। পুলিশের সূত্র জানায়, নিহত ইমরান মুন্সি খুলনার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুর সক্রিয় সদস্য ছিল। তাকে অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাশ গ্রুপের সদস্যরা হত্যা করে বলেও পুলিশের দাবি।
গত ২ অক্টোবর খুলনায় নেশার জন্য দাবি করা টাকা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলে আবু বকর লিমন প্রথমে শ্বাসরোধ ও পরে ধারালো বটি দিয়ে পিতা লিটন খানকে গলা কেটে হত্যা করেছে। খুলনা নগরীর বসুপাড়া বাঁশ তলায় নিজ বাড়িতে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশ ঘাতক লিমন ও তার স্ত্রী চাঁদনীকে গ্রেফতার করেছে।

দৌলতপুর থানাধীন পশ্চিমপাড়া শাহী জামে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে তানভীর হাসান শুভ নামে এক যুবককে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। শুভ ওই এলাকার আবুল বাশারের ছেলে। নিয়মিত বিরতিতে এমন খুনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন মানুষ।

নগর পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, গেল ১০ মাসে খুলনা মহানগরীতে খুন হয়েছে অন্তত ২৬ জন। ৫ আগস্টের পর থেকে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি। এরমধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও নারী সংক্রান্ত বিরোধের জেরে আরও ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া অজ্ঞাতনামা খুনের তালিকায় রয়েছে ৫ জন।

খুলনা মহানগর পুলিশ (কেএমপি) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে নগরীতে ৪৫টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর আগের বছর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ২১টি। হঠাৎ খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। গেল এক বছরে এসব খুনোখুনির ঘটনায় অন্তত দেড়শ আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ২০টি মামলার আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং আদালতে দেওয়া আসামিদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব। পুলিশ জানিয়েছে, অন্তত ১৫টি হত্যাকাণ্ডে মাদক ও স্থানীয় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দ্বন্দ্ব ভূমিকা পালন করে। পুলিশ বলছে, এসব ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে। মাদক এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য যখন টার্গেট কিলিং হয় তখন সেটা রোধ করা কঠিন হয়। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব ও সচেতনতা।

তবে নাগরিক নেতৃবৃন্দ বলছেন ভিন্ন কথা। খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এড. বাবুল হাওলাদার বলেন, মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করছে কম। আগে মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতি ভয় ছিলো। এখন সেই ভয়টা নেই। ফলে মানুষ অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এজন্য পুলিশ প্রশাসনকে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

মামলা বিশ্লেষনে দেখা গেছে, নগরীতে এইসব খুনের ঘটনায় অন্তত: ২৩টি হত্যার সাথে সারাসরি জড়িত খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি চৌধুরী ওরফে গ্রেনেড বাবু, শেখ পলাশ ও আশিক গ্রুপের সদস্যরা। এছাড়া ‘হাড্ডি সাগর’ নামের এক চিহ্নিত অপরাধীর অনুসারীরা এবং নগরীর দৌলতপুর এলাকায় দুটি হত্যাকাণ্ডে চরমপন্থি গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। এছাড়া অন্যান্য খুনের পেছনের কারণ হিসাবে পুলিশ চিহ্নিত করেছে ইজিবাইক ও ভ্যান চুরি নিয়ে দ্বন্দ্বে ৫টি, প্রেমঘটিত বিরোধে খুন ৫টি, পারিবারিক কলহে ৩টি, নদীতে ভেসে আসা লাশ ৩টি, চুরি দেখে ফেলায় হত্যা একটি ও গণপিটুনিতে নিহত একজন এবং অন্যান্য কারণে নিহত ৩ জন।

এ বিষয়ে কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, ‘আমরা ৯০ শতাংশ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। অধিকাংশ মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা এখন কারাগারে। একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতার করা হবে।’

কেএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার(ক্রাইম এন্ড অপারেশনস্) মোহাম্মদ রাশিদুল ইসলাম খান বলেন, মাদকসহ অন্যান্য যেসব কারণে খুন-খারাবি হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে পুলিশ বেশ তৎপর। কিন্তু পারিবারিক কারণে যেসব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে আসলে পুলিশের চেয়ে জনগণকেই আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক বন্ধন বাড়াতে হবে। সন্তানদেরকে পিতা-মাতার বেশি সময় দিতে হবে। জনসাধারণের সহযোগিতা ছাড়া পুলিশের একার পক্ষে আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। তার পরেও পুলিশ ইতোমধ্যে নগরীর ১২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং করেছে। বেশ কিছু ইজিবাইক চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যাতে তারাও সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তথ্য দিতে পারে।